ইট পোড়াতে কাঠের স্তূপ, দূষিত হচ্ছে পরিবেশ
সরকারি আইনের তোয়াক্কা না করে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলায় ইটভাটায় অবাধে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। ইটভাটার পাশে জ্বালানি হিসেবে পোড়াতে কাঠ স্তূপ করে রাখা হয়েছে। তারপরও প্রশাসন এসব ইটভাটার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে ২০১৭ সালের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী উপজেলায় ৬টি ভাটা রয়েছে। তবে ইউএনও জাকির হোসেন জানিয়েছেন বর্তমানে উপজেলায় আটটি ইটভাটা রয়েছে। এদিকে সরেজমিনে উপজেলায় নয়টি ভাটার সন্ধান পাওয়া গেছে। এগুলো হলো একেএফ, এএনএ, এফএএন, জিবিএল-১, জিবিএল-২, এইচবিআই, টিআইবি, এসবি ও এসআইবি ব্রিকস।
এর মধ্যে ভাগলপুরে অবস্থিত এইচবিআই ইটভাটায় কয়লা পোড়ানো হচ্ছে। বাকি আটটি ইটভাটায় পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। ছাড়পত্র না থাকায় গত বছর পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে একেএফ ব্রিকস ও এএনএ ব্রিকসের মালিককে জরিমানা ও ভাটা ভেঙে দেওয়া হয়। তবে এ বছরও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়া এ দুটিসহ অধিকাংশ ভাটায় ইট তৈরির কার্যক্রম চলছে।
অবাধে পুড়ছে কাঠ
এসআইবি ও টিআইবি নামের দুটি ইটভাটার মালিক আজিবর সরদার। ওই দুটি ভাটার শ্রমিক সরদার মামুন ভূঁইয়া বলেন, দুটি ভাটায় ২৫০ জন শ্রমিক কাজ করেন। একেকটি ভাটায় প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৫৫০ মণ কাঠ পুড়ছে। সে হিসাবে আটটি ভাটায় প্রতিদিন অন্তত চার হাজার মণ কাঠ পুড়ছে। ভাটামালিকের নির্দেশে কয়লার পরিবর্তে দুই মাস ধরে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে।
কামরুল শেখ নামের একজন শ্রমিক বলেন, ভাটায় কাঠ ব্যবহার করলে প্রতিটি ইটে খরচ পড়ে ৯ থেকে সাড়ে ৯ টাকা। অন্য দিকে কয়লা ব্যবহার করলে প্রতিটি ইটে খরচ পড়ে সাড়ে ১০ থেকে ১১ টাকা। বর্তমানে প্রতি হাজার ইট সাড়ে ১১ থেকে ১২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ভাটা দুটির সহকারী পরিচালক ফিরোজ সরদার বলেন, ‘ভাটায় আগুন দিতে প্রথমে কাঠের প্রয়োজন হয়। দুই মাস ধরে কাঠ ব্যবহার করছি। দুই মাস আগে প্রতি টন কয়লার দাম ছিল ২৫-২৬ হাজার। বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ৩২ হাজার টাকায়। এখন কয়লা পাচ্ছি না। বাধ্য হয়ে ভাটায় কাঠ পোড়ানো হচ্ছে।’ তাঁর হিসাবে দুটি ভাটায় এ মৌসুমে অন্তত ৫০ হাজার মণ কাঠ লাগবে।
ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পূর্বে পৌরসভার মধ্যে অবস্থিত এএনএ এবং মহাসড়কের পশ্চিমে দেবগ্রামে অবস্থিত একেএফ। সম্প্রতি গিয়ে দেখা যায়, দুটি ভাটায় কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। ভাটা দুটির পাশে জ্বালানি হিসেবে কাঠ স্তূপ করা হয়েছে। এ ছাড়া উজানচরে অবস্থিত ফ্যান ও জিবিএল ভাটাতেও কাঠ পোড়ানো হচ্ছে।
জিবিএল-১ ইটভাটা পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন উসমান মণ্ডল। তিনি বলেন, বছরে ১৪ লাখ টাকা দিয়ে ভাটাটি ভাড়া নিয়েছেন। কয়লার অতিমাত্রায় দাম বৃদ্ধি ও সংকটের কারণে তিনিসহ বেশির ভাগ ভাটায় কাঠ পোড়ানো হচ্ছে।
পরিবেশে ক্ষতিকর প্রভাব
ইটভাটার কারণে গাছপালা ও পরিবেশের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। উপরিভাগের মাটি কেটে নেওয়ায় জমি উর্বরতা হারাচ্ছে এবং দিন দিন পতিত জমি বাড়ছে। ইটভাটার কারণে স্থানীয় লোকজন ভোগান্তিতে পড়ছেন। ইটভাটার ধোয়ার কারণে বাড়ি-ঘরে বসবাস করা কষ্টকর হয়ে উঠছে। ইট পরিবহনের কারণে রাস্তা বেহাল হয়ে পড়ছে।
নজরুল ইসলাম নামের এক কৃষক বলেন, প্রতিদিন শত শত ট্রাক মাটি ইটভাটায় যাচ্ছে। ফসলি জমির ওপরের অংশ কেটে ফেলে মাটি ভাটায় আনা হচ্ছে। এ কারণে আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। ধোঁয়া ও বালুকণার কারণে গাছপালা ও পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
রেজা শেখ নামের একজন বলেন, ‘আমাদের ৩০ বছরের বসতভিটা। আগে একটি ভাটা ছিল। এখন চারপাশে ছয়টি ইটভাটা। ধুলাবালি আর ধোয়ায় ঘরবাড়ি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঘরের ভেতর ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে বাস করছি। বাচ্চারা বাইরে বের হতে পারে না।’
এএসবি ইটভাটার অংশীদার শাহিদ খান বলেন, ‘কয়লা না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে কাঠ পোড়াতে হচ্ছে। স্থানীয়ভাবে রাস্তায় পানি দিয়ে গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করে থাকি।’
ইউএনও জাকির হোসেন বলেন, গোয়ালন্দে আটটি ইটভাটা থাকলেও চলমান রয়েছে ছয়টি। ভাটা স্থাপন আইন অনুযায়ী কাঠ পোড়ানোর সুযোগ নেই। তবে এ বিষয়ে অভিযোগ এসেছে। শিগগিরই এগুলোতে অভিযান চালানো হবে। ইটভাটার লাইসেন্স, পরিবেশের ছাড়পত্র, মাটি কোত্থেকে আসে, সব বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হবে।