গরম আবহাওয়া কি আসলেই Covid-19 corona Virus কে নির্মূল করে? ( BBC FUTURE এ প্রকাশিত Richard Gray লেখা অবলম্বনে)
-আশফাকুর রহমান নিলয়
সংশোধিত প্রকাশ; ০১/০৪/২০২১ইং
“করোনা ভাইরাস আবরনযুক্ত। আবরণযুক্ত ভাইরাস (enveloped viruses) সম্পর্কে গবেষণা করে জানা গেছে যে, ভাইরাসটির এই তৈলাক্ত প্রলেপটি তাপে আরও সংবেদনশীল হয়ে ওঠে এবং তখন ইহা সহজেই ধ্বংস হয়ে যায় অর্থাৎ দীর্ঘক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে না। শীতল পরিস্থিতে তৈলাক্ত প্রলেপটি রাবারের মত শক্ত হয়ে যায়, অনেকটা রান্না করা মাংসের চর্বি যেমন শক্ত হয়ে যায়, তেমনি এটি শক্ত হয়। কারণ, যাতে ভাইরাসকে দেহের বাহিরে প্রতিরক্ষা দিতে পারে অর্থাৎ এ সময় ইহা দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারে”
কিছু মানুষ আশা করছে যে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমে যাবে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী এই সংক্রমণ খুব একটা মৌসুম ভিত্তিক প্রাদুর্ভাবের মত আচরণ করছে না।
অনেক সংক্রামক রোগ এই সময়ের মধ্যে সংঘটিত হয়েছে। ফ্লু সাধারণত বমি বমি ভাব নিয়ে শীতকাল আসে, টাইফয়েডের মতো অন্যান্য রোগ গ্রীষ্মকালে বেশী হয়। নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার কারনে গ্রীষ্মকালে হামের ঘটনা কম ঘটে, যেখানে গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে (শীত কালে)এর সংক্রমণ বেশী ঘটে।
সম্ভবত আশ্চর্যের ব্যাপারই হচ্ছে, অনেক মানুষই এখন জিজ্ঞাসা করছেন যে, তারা কি Covid-19 corona Virus কে মৌসুমি রোগগুলোর সাথে একই রকমের রোগ হিসেবে ধরে নিতে পারেন কি না। যেহেতু ভাইরাসটি চীনে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে আবির্ভাব হয় এবং এটি খুবই দ্রুত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
যেসব অঞ্চলের আবহাওয়া ঠান্ডা থাকে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেসব অঞ্চলে ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। এই কারনে মনে করা হচ্ছিল যে, গ্রীষ্মকাল আসার সাথে সাথে এই রোগটির সংক্রামণ হ্রাস পেতে পারে। আবার অনেক বিশেষজ্ঞরাই ইতোমধ্যে গ্রীষ্মের মধ্যে ভাইরাসটি অধিক হারে ছড়াবে বলেও সতর্ক করে দিয়েছিলেন। তবে এখন বিশেষজ্ঞদের সর্তকতাই সত্য হতে চলেছে।
Covid-19 (coronaVirus) ভাইরাসটির আনুষ্ঠানিকভাবে নামকরণ দেয়া হয়েছে “SARS-CoV-2”, যা কিনা একদমই নতুন এবং মৌসুমের সাথে পরিবর্তিত হচ্ছে। সার্স (Severe Acute Respiratory Syndrome- SARS-CoV) প্রায় এই ভাইরাসের মতই ছিল যা কিনা ২০০৩ সালে খুবই দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল। এর মানে এই মৌসুমে সার্স ভাইরাসটি কিভাবে সংক্রমিত হয়েছিল তার সম্পর্কে কিছু অভিজ্ঞতা রয়েছে। উল্লেখ্য যে, সার্স ও মার্স(Middle East respiratory syndrome coronavirus -MERS-CoV) উভয়ই একই পরিবার ভূক্ত করোনাভাইরাস।
অন্য করোনাভাইরাসের অভিজ্ঞতা হতে Covid-19 corona Virus কিভাবে মানুষের দেহে সংক্রমিত হয় তার সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া গেছে।
কেইট টেম্প্লেটন ইংল্যান্ডের ইডেন বার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক রোগ কেন্দ্র(Centre for Infectious Diseases) এর অধিন ১০ বছর আগে একটি গবেষণা করেছিলেন, যেখানে দেখা গেছে যে, শীতকালীন মৌসুমে এডিনবার্গে হাসপাতালে ও সাধারণ রোগীর চিকিৎসক কর্তৃক সম্পাদিত সার্জারী(General Practitioner surgery) থেকে প্রাপ্ত শ্বাসনালীর সংক্রমিত রোগীদের দেহে ৩ টি করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে। এই ভাইরাসগুলি সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাব্য সময় ছিল ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে। চতুর্থ করোনাভাইরাসটি দূর্বল রোগীদের(patients with reduced immune systems) কাছ থেকে পাওয়া গিয়েছিল, যা অনেকটাই অসংহত ছিল।
Covid-19 corona Virus এর কিছু প্রাথমিক সংকেত রয়েছে, যা মৌসুমের সাথে পরিবর্তিত হতে পারে। নতুন এই ভাইরাসটির ছড়ানো জানান দিচ্ছে যে এটি শীতল ও শুষ্ক অবস্থা বেশি পছন্দ করে।
একটি অপ্রকাশিত পর্যবেক্ষণে এই ভাইরাসটিকে বিশ্বের ৫০০ স্থানের আবহাওয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে, যেখানে Covid-19 corona Virus এর সংক্রমণের সাথে তাপমাত্রা, বাতাসের গতি এবং আপেক্ষিক আর্দ্রতার একটি যোগসূত্র পেয়েছে। আরেকটি অপ্রকাশিত গবেষণায় দেখা যায় যে, উচ্চ তাপমাত্রা Covid-19 corona Virus এর ঘটনা কম হওয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু উল্লেখ্য যে, তাপমাত্রা এককভাবে কখনই বৈশ্বিক এই ঘটনার জন্য দায়ী হতে পারে না।
অপ্রকাশিত গবেষণাগুলি আশঙ্কা করছে যে, উষ্ণ ও শীতল তাপমাত্রা Covid-19 corona Virus এর ছড়ানোর ক্ষেত্রে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, এমনকি শুষ্ক অঞ্চলগুলিও এর মধ্যে রয়েছে। গবেষকরা বলছেন যে, বিশ্বের উষ্ণ প্রধান অঞ্চলগুলি কম ঝুঁকিপূর্ণ।
ইতোমধ্যে ভাইরাসটি সবগুলো মৌসুম শেষ করেছে গবেষকরা এখন মৌসুমভিত্তিক এর আচরণ বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত গ্রহনে সক্ষম হবেন।
কিছু অসাধারন নমুনায দেখা যাচ্ছে যে, Covid-19 corona Virus একটি মৌসুমী স্থানীয় করোনাভাইরাস- এর অর্থ হল ভাইরাসটি যেভাবে মানুষের মাঝে চড়াচ্ছে – তা কিছু সময়ের জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু Covid-19 corona Virus ভাইরাসটি যেভাবে বিশ্বব্যপি ছড়াচ্ছে তাতে ইহা স্থানীয় ভাইরাসের ন্যয় ন্যূনতম আচরণ করছে না।
মহামারীগুলি সচরাচর মৌসুম ভিত্তিক হয়। যেমন স্প্যানিশ ফ্লু সাধারণত শীতকালে ছড়ায়, কিন্তু গ্রীষ্মকালে ইহা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে। বর্তমানে মার্চ মাসের শেষ দিকে এসে বিশ্বে যেভাবে কোভিধ- ১৯ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যু ঘটছে, তাতে এ ভাইরাসটির ক্ষেত্রে একইরূপ ঘটতে চলেছে।
স্টকহোমের কারোলিন্সকা ইউনিস্টিটিউটের এর ভাইরাস সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের অধ্যাপক জ্যান অ্যালবার্ট বলেন,“অবশেষে আমরা Covid-19 corona Virus কে স্থানীয়ভাবে গ্রহণ করে নিচ্ছি”। তিনি আরও বলেন, “আরও আশ্চর্যজনক হবে যদি এটি মৌসুমী প্রভাব না দেখায়। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, এই ভাইরাসটির সংবেদনশীলতা এই মৌসুমে প্রভাবিত হয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছড়াবে কি না – আমরা সেটা জানি না, কিন্তু আমাদের মনে করতে হবে যে এটি সম্ভব।”
আমরা অন্যান্য করোনাভাইরাসের আচরণ সম্পর্কে যখন বর্তমান Covid-19 এর সংক্রমণ নিয়ে অনুমান করব, তখন আমাদেরকে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে। কিন্তু কেন করোনাভাইরাস মৌসুমের সাথে সম্পর্কিত এবং কেন এটি এই প্রাদুর্ভাব হ্রাসের ব্যাপারে আশা দিচ্ছে?
করোনাভাইরাস একটি আবরনে মেড়ানো ভাইরাস (Enveloped Viruses) এর পরিবারভূক্ত। তার মানে এরা তৈলাক্ত প্রলেপ দ্বারা আবরনযুক্ত, যা “lipid bilayer” নামেও পরিচিত। ভাইরাসটি প্রোটিন দিয়ে আবৃত এবং আবরনটিতে মুকুটের সূঁচালো কাঁটার মত চারদিকে ছড়িয়ে থাকে। ভাইরাসটির নামকরন হতেও ইহা বুঝা যায়, ল্যাটিন ভাষায় করোনা অর্থ মুকুট।
অন্যান্য আবরণযুক্ত ভাইরাস (enveloped viruses) সম্পর্কে গবেষণা করে জানা গেছে যে, ভাইরাসটির এই তৈলাক্ত প্রলেপটি তাপে আরও সংবেদনশীল হয়ে ওঠে এবং তখন ইহা সহজেই ধ্বংস হয়ে যায় অর্থাৎ দীর্ঘক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে না। শীতল পরিস্থিতে তৈলাক্ত প্রলেপটি রাবারের মত শক্ত হয়ে যায়, অনেকটা রান্না করা মাংসের চর্বি যেমন শক্ত হয়ে যায় তেমন। এটি শক্ত হয় কারণ যাতে ভাইরাসকে দেহের বাহিরে প্রতিরক্ষা দিতে পারে অর্থাৎ এ সময় ইহা দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারে। অধিকাংশ আবরণযুক্তন ভাইরাস মৌসুম ভিত্তিক শক্তিশালী প্রভাব দেখায়।
গবেষণায় ইতোমধ্যে দেখাচ্ছে যে, SARS-CoV-2 প্লাস্টিক এবং স্টেইনলেস স্টীলের মত শক্ত পৃষ্ঠে ২১-২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস(৭০-৭৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট) তাপমাত্রা ও ৪০ শতাংশ আপেক্ষিক আর্দ্রতায় ৭২ ঘন্টা পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। Covid-19 corona Virus ভাইরাসটি অন্যান্য তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় কি রকম আচরণ করে তা এখনও পরীক্ষা করা হচ্ছে। কিন্তু অন্যান্য করোনাভাইরাসের গবেষণা বলছে যে, তারা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এ ২৮ দিনেরও বেশি বাঁচতে পারে।
২০০৩ সালে সার্স এর প্রাদুর্ভাবের পর জানা যায় যে, ভাইরাসটি শুষ্ক ও ঠান্ডা পরিবেশে অধিক সময় বেঁচে থাকতে পারত। যেমন, শুষ্ক তাপমাত্রা ও ৪০-৫০ শতাংশ আপেক্ষিক আর্দ্রতায় সার্স মসৃণ তলের উপর ৫ দিনেরও বেশি সময় ধরে বেঁচে থাকতে পারে। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা যত বেশি হবে, ভাইরাস তত কম সময়ে বেঁচে থাকতে পারে।
মিগুয়েল আরাউজো যিনি পরিবেশগত পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট জীববৈচিত্রের প্রভাবের বিষয়ে স্পেনের মাদ্রিদের জাতীয় যাদুঘরের অধিন প্রকৃতিক বিজ্ঞান শাখায় আবহাওয়া পরিবর্তণ জীববৈচিত্রের উপর কিভাবে প্রভাব ফেলে (Environmental change on biodiversity) বিষয়ে লেখাপড়া করছেন, তিনি বলেন, “যখন ভাইরাস মানবদেহের বাহিরে আসে যেমন হাঁচি বা কাশির দ্বারা, তখন জলবায়ু একে স্থায়িত্ব প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে”। তিনি আরও বলেন, “ভাইরাস যত বেশি পরিবেশের মধ্যে স্থায়ীভাবে থাকবে, অন্যান্য মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ও মহামারী আকার ধারণ করার ক্ষমতা তার ততধিক হবে। দেখা যাচ্ছে যে, SARS-CoV-2 খুবই দ্রুত সারা বিশ্বের ঠান্ডা ও শুষ্ক আবহাওয়ার অঞ্চলসমূহকে বেশী আক্রান্ত করছে”
তার কম্পিউটারের মডেলগুলি বিশ্বব্যাপী মহামারীগুলোর ধরণের সাথে মিলে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, যেখানে গ্রীশ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের বাহিরে সংক্রমণের সংখ্যা অধিক।
আরাউজো বিশ্বাস করেন যে, Covid-19 corona Virus যদি তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার সাথে একই সংবেদনশীলতা ভাগাভাগি করে, তবে করোনাভাইরাস বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।
তিনি বলেন, “২টি ভাইরাস যে তাদের মধ্যকার আচরণকে ভাগাভাগি করবে তা মনে করা হচ্ছে” । তিনি আরও বলেন যে, “কিন্তু এটি কোনো এক প্রকার পরিবর্তণশীল সমীকরণ নয়। ভাইরাসটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়াচ্ছে, যদি বেশি মানুষ কোনো জায়গায় একসাথে থাকে এবং একে অপরের সংস্পর্শে আসে, তবে সেখানে আরও সংক্রমণের ঘটনা ঘটবে। মানুষদের আচরনই বলে দিবে ভাইরাসের প্রসারণের আকারকে।“
মেরীল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, বিশ্বের যেসব শহর বা অঞ্চলে গড় তাপমাত্রা ৫-১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস(৪১-৫২ ডিগ্রি ফারেনহাইট)এবং আপেক্ষিক আর্দ্রতা কম, সেসব জায়গায় ভাইরাসটি ছড়িয়েছে বেশী।
কিন্তু গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলেও যথেষ্ট সংখ্যক সংক্রমিত মানূষ রয়েছে। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের গবেষকেরা এশিয়াতে ভাইরাসটির ছড়িয়ে পড়া নিয়ে সাম্প্রতিক একটি পর্যালোচনা করেছেন, যেখানে বলা হচ্ছে যে, বিশ্বব্যাপী এই করোনাভাইরাস আবহাওয়ার কাছে কম সংবেদনশীল।
তারা বলছে যে, চীনের শুষ্ক ও শীতল অঞ্চলে যেমনঃ জিলিন এবং হিলংজিয়াং এ ভাইরাসের সংক্রমণ এবং গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলগুলোতে যেমনঃ গুয়্ংসি ও সিঙ্গাপুরে প্রায় একইরূপ দেখা যাচ্ছে। গুয়্ংসি ও সিঙ্গাপুরে বসন্ত এবং গ্রীষ্মের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বৃদ্ধির প্রভাব থাকা সত্বেও এর সংক্রমণকে ঠেকাতে পারেনি। তারা বলেছে যে, এই রোগ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে জনস্বাস্থ্যের সচেতনতা প্রয়োজন।
এর কারণ হচ্ছে এই ভাইরাসটির ছড়ানোর বিষয়টি যে কোন পরিবেশে এর বেঁচে থাকার ক্ষমতার উপর নির্ভর করে Covid-19 corona Virus এর মত রোগের ক্ষেত্রে যারা এখন ভাইরাসটি ছড়াচ্ছেন, মানুষের ব্যবহারে মৌসুমী পরিবর্তনের সাথে সাথে সংক্রমণের হারও পরিবর্তণ হতে পারে।
উদাহরনস্বরূপ, দেখা যাচ্ছে যে, ইউরোপে স্কুলগুলো যখন খোলা থাকে, হাম তখন বেশী ছড়ায়। আর স্কুল যখন বন্ধ হয়ে যায়, হাম তখন কম ছড়ায়। কারণ পরস্পরের সংস্পর্শের কারনেই হামের ভাইরাসটি বেশী ছড়ায়। ২৫ জানুয়ারী২০২০ এ চীনের লুনার নববর্ষে অধিক লোকসমাগমের কারণকে চীনের উহান থেকে অন্যান্য শহর ও বিশ্বের অন্যান্য স্থানে করোনাভাইরাসটি ছড়ানোর ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করছে বলে মনে করা হচ্ছে।
আবহাওয়া আমাদের নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে নিয়েও ঝামেলা করতে পারে, যা সংক্রমণের ঝুঁকিকে বাড়িয়ে তোলে। কিছু প্রমাণ রয়েছে, যা বলছে যে আমাদের শরীরে ভিটামিন ডি এর পরিমান আমরা এই ভাইরাসের সংক্রমণে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ তা জানাচ্ছে। শীতকালীন সময়ে আমাদের শরীর সূর্যের আলো থেকে কম ভিটামিন ডি তৈরী করে। এর কারণ হচ্ছে আমরা ঘরের মধ্যে বেশি সময় কাটাই এবং নিজেদেরকে ঠান্ডা বাতাস থেকে বাঁচতে সকলে শীতকালীন পোষাক পড়ে। কিন্তু কিছু গবেষণা বলছে যে, এই তত্ত্বটি ফ্লুর মতো রোগ মৌসুমের পরিবর্তনের জন্য দায়বদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা কম।
আরও বিতর্কিত বিষয় হচ্ছে, ঠান্ডা আবহাওয়া আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দূর্বল করে দিচ্ছে কি না। কিছু গবেষণা বলছে যে, এটি হয়েছে, কিন্তু ঠান্ডা আমাদের শরীরে থাকা রোগ প্রতিরোধকারী কোষগুলির সংখ্যাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে যাতে আমাদের দেহ প্রতিরক্ষা পায়।
আর্দ্রতা যে আমাদের রোগটি হওয়ার ঝুঁকিতে আরও বেশি প্রভাব ফেলতে পারে তার শক্ত প্রমাণ রয়েছে। যখন বাতাস শুষ্ক থাকে, তখন আমাদের ফুসফুস ও বাতাসের পথগুলিতে মিউকাস কোটিং এর পরিমান হ্রাস পাওয়ার কথা ভাবা হয়। এই আঁঠালো নির্সত রসটি ভাইরাসের সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক সুরক্ষা দেয় এবং এর কম হলে আমরা ভাইরাসের ঝুঁকিতে বেশি থাকি।
চীনের বিজ্ঞানীদের একটি আগ্রহজনক গবেষণায় জানা গেছে যে, Covid-19 (corona Virus) এর ভয়াবহতা ও আবহাওয়ার অবস্থার সাথে কিছু যোগসূত্র রয়েছে। তারা চীনের উহানে প্রায় ২,৩০০ মৃত্যুর তথ্য সরেজমিনে সংগ্রহ করেছে এবং তাদের প্রত্যেকের মৃত্যুর দিনের আর্দ্রতা, তাপমাত্রা ও দূষণের মাত্রার সাথে তুলনা করা হয়েছে।
যদিও এটি এখনও একাডেমিক জার্নালে প্রকাশিত হয়নি, তাদের গবেষণা বলছে যেদিন আর্দ্রতার মাত্রা ও তাপমাত্রা অধিক ছিল সেদিন মৃতের হার কম ছিল। তাদের গবেষণা আরও বলছে যে, যেদিন তাপমাত্রা সর্বাধিক ও সর্বনিম্ন ছিল, সেদিন মৃতের সংখ্যাও বেশি ছিল্। কিন্তু এই পুরো কাজটি কম্পিউটার মডেলের ওপর নির্ভর করে করা হয়েছিল। তাই এর যোগসূত্রের আসল প্রকৃতি এবং এটি বিশ্বের অন্যান্য আর কোথাও দেখা যাবে কি না তা এখনও অনুসন্ধান করা হচ্ছে।
যেহেতু Covid-19 corona Virus ভাইরাসটি বিশ্বব্যাপী নতুন, তাই যদি কেউ এই ভাইরাসটির দ্বারা আক্রান্ত হয়, তবে তার দ্বারা যাতে অন্য কেউ সংক্রমিত না হয় – তাই সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তাকে বিছিন্ন থাকতে হবে।
ফ্রান্সের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা বিষয়ক পরিচালক ভিক্টোরিয়া কলিজ্জা বলেছেন, বিশ্বব্যাপী ভাইরাস ছড়ানোর ক্ষেত্রে বিমান ভ্রমণ সবচেয়ে বড় পথ। কিন্তু যখন এটি কমিউনিটি এর মধ্যে ছড়ানো শুরু করে, তখন এর সংক্রমণ যানবাহন চালকদের সংস্পর্শে আসা লোকদের দ্বারা সংঘটিত হয়। লোকজনদের মাঝে যোগাযোগ বন্ধ করাও সংক্রমণের হার কমাতে সহায়তা করবে। বর্তমানে বিভিন্ন দেশের সরকার জনসমাগমের স্থানগুলোকে লকডাউন(Shut down) করে দিচ্ছে যাতে করে সংক্রমণের সংখ্যা কম হয়।
কলিজ্জা বলেন যে, “Covid-19 corona Virus এর মধ্যে এখনও কোনো মৌসুমী আচরণের প্রমাণ পাওয়া যায়নি”। তিনি আরও বলেন যে, “মৌসুমী উপাদান এক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করতে পারে”। কিন্তু এই ভাইরাসটির বিস্তার ঠেকাতে এই ব্যবস্থা নেয়াটা যথেষ্ট হবে কি না – তার সম্পর্কে তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, “সংস্পর্শে আসার পরিমাণ কমানোর মাধ্যমে ভাইরাসটির সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষেত্রে এটি কম ছড়াবে”।
যদি Covid-19 corona Virus এর সংক্রমণের সংখ্যা আসন্ন মাসগুলিতে সত্যিই বন্ধ হয়ে যায়, তবে এর জন্য বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। বিচ্ছিন্ন থাকা এবং লকডাউন (Shut down) এর মত প্রতিরোধমূলক ব্যাপারগুলি এক্ষেত্রে সফলতার কারণ। অ্যালবার্টের মডেল বলছে, জনসংখ্যার মধ্যে ক্রমবর্ধমান প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে বা এটি মৌসুমে প্রভাব ফেলতে পারে।
অ্যালবার্ট সতর্ক করে দিয়েছেন যে, “যদি মৌসুমী প্রভাব থাকে, এটি অন্যান্য ২টি প্রকৃত প্রভাবকে ঢেকে দিতে পারে”। তিনি আরও জানান, “যেসব দেশগুলোর জনগনের কাছে লকডাউনের(Shut down) অর্থ ঠিকভাবে প্রকাশিত হয়নি, তাই আমি বছরের শেষ দিকে ও শীতকালে সংক্রমণের ২য় প্রবাহ দেখে আশ্চর্য হব না”।
যদি Covid-19 corona Virus মৌসুমী কিছু পরিবর্তনশীলতা দেখায়, তবে কারও কারও মতে এটি গরমকালে সার্বিকভাবে নির্মূল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু সংক্রমণের গভীর পর্যালোচনা কিছু ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।
অ্যালবার্ট বলেন, “ Covid – 19 corona Virus আক্রান্তের উর্ধ্বমূখী রেখাকে সমতল করার জন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে তা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অনেক ব্যয়বহুল, কিন্তু এটি এই মহামারীটিকে গ্রীষ্মের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করবে।” তিনি আরও বলেন, “যদি এটি মৌসুমী কোনো ঘটনা হয়, তবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সামগ্রী কিনতে প্রস্তুতি এখনি নিতে হবে” ।
বিশ্ব আজ এই ভাইরাসের ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ ঠেকাতে কাঁপছে, সবাইকে উচিত এটিকে ঠেকানোর জন্য সময় দেয়ার।
(মূল লেখাটি BBC FUTURE এ প্রকাশিত Richard Gray লেখা অবলম্বনে হয়েছিল)