ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে সুন্দরবনে জীববৈচিত্র্যে
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তছনছ করে দিয়েছে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থান। বনের অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর উপচে পড়া পানির স্রোতে ভেসে গেছে বহু বন্যপ্রাণী।
ইতোমধ্যে, বিভিন্ন এলাকা থেকে ৪টি মৃত ও ২টি জীবিত হরিণ উদ্ধার করা হয়েছে। সমুদ্রের লোনা পানিতে ডুবছে বনের মিষ্টি পানির পুকুর ও জলাশয়। এর ফলে বনের প্রাণিকুলের আহার পরগাছা ও লতাপাতা নষ্ট হয়েছে। এতে বন্যপ্রাণীর খাদ্যাভাবসহ তাদের জীবন আচরণে বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এক পরিসংখানে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরের কূল ঘেঁষে গড়ে ওঠা ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ভয়াবহ আগ্রাসন থেকে এ দেশের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের জনবসতির প্রাকৃতিক প্রাচীর হিসাবে কাজ করে।
এ বনে রয়েছে ৩১ শতাংশের জলভাগে ৪৫০টি নদ-নদী এবং খাল, বনে লবণাক্তভোজী প্রধান উদ্ভিদ সুন্দরীসহ আরো রয়েছে ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা ও ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল এবং ১৩ প্রজাতির অর্কিড।
সুন্দরবনে, ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী রয়েছে। এর মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল এবং মায়া হরিণ, বিলুপ্তপ্রায় ইরাবতিসহ ছয় প্রজাতির ডলফিন, লোনা পানির কুমির, কচ্ছপ এবং কিং কোবরাসহ বিভিন্ন প্রজাতির সাপ রয়েছে, আরো রয়েছে ৩১৫ প্রজাতির পাখি।
সুন্দরবনের ১ হাজার ৮৭৪ দশমিক ১ বর্গ কিলোমিটার জলভাগের নদ-নদীতে রয়েছে, ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া, ৪৩ প্রজাতির মলাস্কা এবং এক প্রজাতির লবস্টার।
বিগত কয়েক বছরে সুন্দরবনে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, বুলবুল, মহাসেন ও আম্পানের মতো তাণ্ডব থেকে এ বন বাঁচিয়ে রাখে পার্শ্ববর্তী জনবসতি। আর এতে মানবকুলের ক্ষতির পরিমান কমলেও প্রতি বছরই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য।
এবার ঘূর্ণিঝড় ইয়াস সরাসরি সুন্দরবনে আঘাত না হানলেও বঙ্গোপসাগরে ফুঁসে ওঠা জলোচ্ছ্বাস অনেকটাই ঠেকিয়ে দিয়েছে সুন্দরবন। আর এতে ব্যাপক পরিমানে ক্ষতি হয়েছে বনের জীববৈচিত্র্যের।
পানিতে ডুবে গেছে পর্যটন স্পট কটকা, কচিখালী, হিরন পয়েন্ট দুবলা, আলোরকোল ও করমজল এবং বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রসহ বিস্তীর্ণ এলাকা। লোনা পানিতে পরিপূর্ন হয়ে যায় প্রাণীদের আবাসস্থল। স্রোতে ভেসে গেছে হরিণ, বানর, অজগরসহ অসংখ্য প্রাণী।
সুন্দরবনের পূর্বাঞ্চল করমজলে বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ইনচার্জ হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, পশুর নদীর ফুঁসে ওঠা পানিতে মুহূর্তেই প্লাবিত হয়ে যায় হরিণ, কুমির ও কচ্ছপ প্রজনন কেন্দ্রের স্থাপনা। তবে এ কেন্দ্রের প্রাণীরা নিরাপদে রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, জলোচ্ছ্বাসের প্রভাবে পশুর নদী এবং প্রজনন কেন্দ্রের আশপাশের এলাকায় সজারু ও গুইসাপসহ অন্যান্য কিছু প্রাণী স্রোতের টানে ভেসে যেতে দেখা গেছে। বনের বিভিন্ন এলাকা থেকে ভেসে আসা প্রাণীদের উদ্ধারে বনরক্ষীরা তৎপরতা চালিয়েছেন বলে জানান তিনি।
বনবিভাগের হিসাব অনুযায়ী, ইয়াসের প্রভাবে সুন্দরবনে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫-৬ ফুট বেশি পানি ওঠে। এতে বনের বিভিন্ন টহল ফাঁড়ি, স্টেশনের ১৯টি জেটি,একটি ফুট রেইল, দুটি গোলঘর, ওয়াচ টাওয়ার সহ চারটি স্টাফ ব্যারাক এবং একটি রেস্ট হাউজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অফিসের দুটি রাস্তা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এতে প্রাথমিক হিসাবে সুন্দরবনের প্রায় ৬০ লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি হয়েছে।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের কর্মকর্তা (ডিএফও) বেলাতে হোসেন বলেন, ইয়াসের প্রভাব ও জলোচ্ছ্বাসে গাছপালার তেমন একটা ক্ষতি হয়নি। কিন্তু স্রোতের টানে ভেসে যাওয়া ৪টি মৃত এবং ২টি জীবিত হরিণ উদ্ধার করে বনবিভাগ।
এ ছাড়া বনের ভিতরে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল, পর্যটন স্পট ও বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের স্থাপনার অনেকটা ক্ষতি হয়েছে। তিনি বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিপূর্ণ হিসাব পাওয়া যাবে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও বিজ্ঞান ডিসিপ্লিন বিভাগের প্রফেসার ডক্টর আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, জলোচ্ছ্বাসে বন্যপ্রাণীর খাবার পানির প্রধান উৎস পুকুর ও জলাশয় লোনা পানিতে ডুবে গেছে। এর ফলে বাধ্য হয়েই প্রাণীরা লবণাক্ত পানি পান করে পেটের পীড়াসহ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়বে। এতে প্রাণিকুলের জীবন আচারণের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে।
সুন্দরবনের অভ্যন্তরে লোনা পানির প্লাবনে এর জীববৈচিত্র্যে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বাগেরহাট জেলা সমন্বয়কারী নুর আলম শেখ। তিনি আরো বলেন, প্রাণিকুলের খাদ্য হচ্ছে উদ্ভিদ জাতীয় লতাপাতা। লবণ পানিতে উদ্ভিদ প্রজাতি নষ্ট হলে বন্যপ্রাণীদের খাদ্য সংকট হতে পারে। এই খাদ্য সংকটের কারণে প্রাণীরা আবাসস্থল পরিবর্তনের জন্য বাধ্য হবে। এর ফলে খাদ্যের জন্য পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল প্রাণীরা বনের আরও গহিনে বা লোকালয়মুখী হয়ে পড়বে। এ ছাড়া বাঘ, হরিণ, কুমিরসহ প্রাণিকুলের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হবে।