সেন্টমার্টিনের পানিতে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া
শীত মৌসুমে পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় সেন্টমার্টিন দ্বীপ। ছুটির দিনে ৫-৬ হাজার পর্যটক এবং সাধারণ দিনগুলোতে দেড় থেকে দুই হাজার পর্যটক এই দ্বীপ ভ্রমণ করেন।
পর্যটকদের চাপে এই দ্বীপের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কথা অনেক আগে থেকেই বলে আসছিলেন পরিবেশবাদীরা। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সমুদ্রের পানি ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া দিয়ে দূষণের ঘটনা।
শুধু সৈকতের কাছেই নয়, দ্বীপের এক কিলোমিটার বিস্তৃত এলাকার পানিতেও ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পেয়েছে বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষকরা।
গবেষকরা জানান, পানিতে ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় থাকার কথা। কিন্তু পরীক্ষা করে জানা গেছে, সেন্টমার্টিনের পানিতে এই ব্যাকটেরিয়ার মাত্রা কয়েকগুণ বেশি। যাকে সহজ ভাষায় ভয়াবহ মাত্রা বলা হয়।
‘ই-কোলাই’ ব্যাকটেরিয়া মানুষের মলমূত্র থেকে জন্ম নেয়। আমেরিকান পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশনের ম্যামব্রেইন ফিলটেশন ম্যাথড অনুসরণ করে এই গবেষণা করেছেন তারা।
এতে সেন্টমার্টিনের চারপাশের সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন এলাকা এবং সৈকত থেকে ১ কিলোমিটার গভীর সমুদ্র এলাকার পানি সংগ্রহ করে গবেষণা করা হয়। পানিতে ফিকাল কলিফরমের উপস্থিতি পাওয়া গেলে সেই পানি ‘ই-কোলাই’ ব্যাকটেরিয়া আক্রান্ত বলে ধরা হয়।
ইশেরশিয়া কোলাই বা ই-কোলাই হলো অণুজীব জগতের অত্যন্ত পরিচিত একটি নাম। ই-কোলাই আক্রান্ত হলে পেট ব্যথা , পাতলা পায়খানা, গ্যাস, ক্ষুধামন্দা, বমি ভাব, জ্বর—এই ধরনের উপসর্গ দেখা যায়।
রোগ আরও খারাপ পর্যায়ে গেলে প্রস্রাবে রক্ত যাওয়া, প্রস্রাব কমে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়। তার থেকে ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে অনেক অ্যান্টিবায়োটিক এটির বিরুদ্ধে কাজ করে না।
গবেষকরা জানান, সেন্টমার্টিনের সৈকতের পানিতে প্রতি ১০০ মিলিলিটারে ১ থেকে ২৭২ সিএফইউ ফিকাল কলিফরম অর্থাৎ ‘ই-কোলাই’ ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের ১০০ মিলিলিটার পানিতে যদি ২০০’র ওপরে টোটাল কলিফরম পাওয়া যায় সেটাকে দূষিত হিসেবে ধরা হয়।
ফিকাল কলিফরম যেটাকে ‘ই-কোলাই’ বলা হয় সেটি প্রতি ১০০ মিলিলিটার পানিতে ১০০ থেকে ২০০’র ওপরে পাওয়া যায় তাহলে তাকে দূষিত ধরা হয়। গবেষকরা পরীক্ষা করে– সৈকতের পানিতে এবং সৈকত থেকে ১ কিলোমিটার দূরের পানিতেও ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পান। পর্যটক মৌসুমের সঙ্গে সাধারণ সময়ের তফাৎ দেখা গেছে পর্যটন মৌসুমে ৬৩ শতাংশ এবং সাধারণ সময়ে ৩৭ শতাংশ।
গবেষক দলের প্রধান বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মীর কাশেম বলেন, আমরা পর্যটন মৌসুমে সৈকতের পানিতে টোটাল কলিফরম পেয়েছি ১৫-৬৫৭ সিএফইউ প্রতি ১০০ মিলিলিটার পানিতে।
যেখানে ই-কোলাই পাওয়া গেছে ১-২৭২ সিএফইউ প্রতি ১০০ মিলি পানিতে। অন্যদিকে সমুদ্রের পানিতে আমরা টোটাল কলিফরম পেয়েছি ২৬-১৮১০ সিএফইউ প্রতি ১০০ মিলিলিটার পানিতে। যেখানে ই-কোলাই পাওয়া গেছে ৩২-২৮০ সিএফইউ প্রতি ১০০ মিলি পানিতে।
গবেষকরা জানান, সেন্টমার্টিন দ্বীপের উত্তর সৈকতের কাছে যেখানে পর্যটকরা বেশি অবস্থান করেন এবং জেটি সংলগ্ন এলাকায় ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ বেশি। আবার পশ্চিম সৈকতের থেকে ১ কি.মি দূরে সবচেয়ে বেশি ই-কোলাই পাওয়া গেছে।
টোটাল কলিফরম বেশি পাওয়া গেছে সেন্টমার্টিন দ্বীপের ভেতরে দারুচিনি লেক সংলগ্ন এলাকায়। পর্যটকদের কারণে সৃষ্ট মলমূত্র ব্যবস্থাপনা দ্বীপে নেই। যা যাচ্ছে সবই সাগরে পড়ছে। যার কারণে এমনটি হচ্ছে বলে জানান গবেষকরা।
মীর কাশেম বলেন, আমাদের গ্রাউন্ড ওয়াটার নিয়ে কোনও কাজ ছিল না। আমরা বিচ ওয়াটার পরীক্ষা করেছি। গ্রাউন্ড ওয়াটার নিয়েও আমাদের গবেষণা চলমান আছে। বিচে যে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা আছে সেটার পাশে যদি নলকূপ থাকে তাহলে সেই পানিও দূষিত হতে পারে।
আমরা পরীক্ষা করে দেখবো খাবার পানির মান কেমন আছে। পর্যটক মৌসুমে যে পরিমাণ মানুষ যাচ্ছে তাতেই দ্রুত প্রভাব ফেলছে। মানুষের মলের মধ্যেই ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া থাকে। জেটি ঘাটের জায়গায় ই-কোলাইর পরিমাণ বেশি থাকার একটা কারণ হতে পারে যে পর্যটকদের নিয়ে জাহাজগুলো এখানে ভিড়ছে।
এই জাহাজ থেকে পয়ঃনিষ্কাশনের যে আবর্জনা সেটা পানিতে ফেলা হয়। আবার পর্যটক মৌসুম ছাড়াও আমরা বেশি পেয়েছি। কারণ, তখন নৌকাগুলো থাকে। সেখান থেকে দূষণ হচ্ছে।
গবেষকরা পরামর্শ হিসেবে জানিয়েছে, বর্জ্য থেকে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট করা ও আর পর্যটক নিয়ন্ত্রণ করার বিকল্প এখানে নেই।