সিসার উপস্থিতি মিলছে বাজারের তাজা মাছে
চলতি বছরের শুরুতে গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে একসঙ্গে মারা গেছে ১১টি জেব্রা। জেব্রাগুলোর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে এসেছে এদের মৃত্যু হয়েছে সিসাসহ কয়েকটি ভারী ধাতুর বিষক্রিয়ায়।
যা জেব্রার পেটে এসেছে ঘাসের মাধ্যমে। সম্প্রতি বছরগুলোতে করা কয়েকটি গবেষণায় উঠে এসেছে, যেই সিসার দূষণে মারা গেল এতগুলো জেব্রা, সেই সিসার উপস্থিতি মিলছে বাজারের তাজা মাছেও।
যা খাদ্য হিসেবে যাচ্ছে মানুষের পেটে। চিকিৎসক ও গবেষকরা বলছেন, সিসার এই দূষণে জেব্রার মতো তাৎক্ষণিক মানুষের মৃত্যু না হলেও ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে একটি অসুস্থ প্রজন্ম।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতি ডেসিলিটার রক্তে ০.৫ মাইক্রোগ্রাম সিসার উপস্থিতিকে আশঙ্কাজন ধরা হয়। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে সিসার পরিমান ০.৩ মাইক্রোগ্রাম হলেই বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে।
২০১৯ সালে ইনস্টিটিউট অব হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড এভালুয়েশন জানায়, বিশ্বে ৬২.৫ শতাংশ বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতার জন্য সিসা দূষণ দায়ী। বাংলাদেশে অন্তত ৬০ শতাংশ শিশুর রক্তে সীসার উপস্থিতি রয়েছে। সংখ্যা হিসেবে যার পরিমান ১ কোটির বেশি।
দেশের বিভিন্ন খাদ্যপণ্যে সিসার উপস্থিতি নিয়ে ২০১৫ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত অন্তত ৪টি গবেষণার তথ্য পাওয়া যায়। সবশেষ ২০২১ সালে জার্নাল অব হেলথ এন্ড পলিউশনে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে রাজধানীর কারওয়ান বাজার থেকে সংগৃহিত প্রতিকেজি পাঙ্গাস মাছে ৩০.৮ মাইক্রোগ্রাম, রুই মাছে ১৫.৩৩ মাইক্রোগ্রাম ও কাতলা মাছে ১৫.৮৬ মাইক্রোগ্রাম সীসার উপস্থিতি পাওয়া যায়।
একই গবেষণায় সবচেয়ে দূষিত নদী বুড়িগঙ্গা থেকে ধরা প্রতিকেজি টেংরা মাছে ১১.৬৮ মাইক্রোগ্রাম, চাপিলা মাছে ১০.২৩ মাইক্রোগ্রাম, টাকি ও বাইলা মাছে ৯.৯১ মাইক্রোগ্রাম ও পাঙ্গাস মাছে ০.৭৪ মাইক্রোগ্রাম সিসার উপস্থিতি পাওয়া যায়।
তবে বুড়িগঙ্গার মাছে সিসার বেশি উপস্থিতি পাওয়া গেলেও চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর প্রতিকেজি পোয়া মাছে ০.৮৮৬ মাইক্রোগ্রাম, চিরিং মাছে ১.৮৪ মাইক্রোগ্রাম, টেংরা মাছে ২.৮৬ মাইক্রোগ্রাম ও চাপিলা মাছে ৭.৭ মাইক্রোগ্রাম সিসা পাওয়া যায়। একইসঙ্গে উত্তরের নদী করতোয়ার চিংড়ি মাছে ০.০৩৩ মাইক্রোগ্রাম ও তারা বাইম মাছে পাওয়া যায় ০.০৩৬ মাইক্রোগ্রাম সিসা।
এর আগে ২০১৭ সালে ফিসারিজ এন্ড এগ্রিকালচার জার্নালে প্রকাশিত আরেক গবেষণায় ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা বাজারে তেলাপিয়া মাছে সর্বোচ্চ ১৬.৩৮৬ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত সিসা পাওয়া যায়।
অন্য গবেষণাগুলোতেও দেশের শহর এবং গ্রামাঞ্চলের মাছে সীসার অস্বাভাবিক উপস্থিতি পাওয়া গেছে। অধিকাংশ গবেষণায় চাষের মাছে সিসা বেশি পাওয়া গেছে।
নদী ও পুকুরের মাছে ক্ষতিকর এই ভারী ধাতু কিভাবে এলো জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিসার সবচেয়ে বড় উৎস্য পরিত্যক্ত ব্যাটারি। এছাড়া ভবনে রঙের উজ্জলতা বাড়াতে, গাছের পাতায় কীটনাশকের স্থায়ীত্ব বাড়াতে, ডাইং হাউসের কাপড়ের রঙে এবং কলকারখানা থেকে নানান মাধ্যম হয়ে শেষ পর্যন সিসা আসছে নদীতে।
পরে সেটি মাছসহ নদীর প্রাণীদের খাদ্যে পরিণত হচ্ছে। যা শেষ পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে মানুষের পেটে। যে নদীতে দূষণ বেশি সেই নদীর মাছেও সিসার উপস্থিতি বেশি মিলছে।
পরিবেশবাদী গবেষণা সংস্থা এনভায়নমেন্ট অ্যান্ড সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো) মহাসচিব ড. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, ‘শুধু মাছে না কাঁচা ও শুকনা হলুদ-মরিছেও সিসার অনেক বেশি উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এটা দুই ভাবে আসছে। প্রথমত জমিতে চাষ করার সময় ফসলে সিসা মেশানো কীটনাশক ছেটানো হয়।
সেটা হলুদ-মরিছসহ সব ধরনের সবজিতে মিশে যায়। এর কিছু অংশ পানিতে ভিজে নদীতেও যায়। আবার হলুদ-মরিছে বাজারজাত করার সময় রঙ বাড়াতে সিসা মেশানো হয়। এগুলো যেভাবেই হোক ঘুরেফিরে মানুষের পেটে আসে।’
সিসার উৎস্যগুলো জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা গবেষণা করে বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি হওয়া অধিকাংশ রঙে সিসার অতিরিক্ত উপস্থিতি পেয়েছি। ডাইং হাউজে কাপড়ে ব্যবহৃত রঙেও সিসা থাকে। যা পরে নদীতে মিশে।
এছাড়া, ব্যাটারি থেকে এবং কলকারখানা থেকে সিসা ছড়ানোর চিত্র আমাদের গবেষণায় উঠে এসেছে। যা ঘুরেফিরে নদীতেই যায়। আবার খাদ্য হয়ে মানুষের পেটে আসে।
সিসা কিভাবে ক্ষতি করে তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমরাতো দেখেছিই এতগুলো প্রাণীর মৃত্যু হয়েছে। সেখানথেকে বুঝা যায় এটা খুবই বিপজ্জনক। তবে মানুষের শরীরে এটি হঠাৎ এটাক করে না। সিসা স্লো পয়জনিং করে।
রক্তে যখন এর মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যায় তখন এটি মস্তিষ্কের সমস্যা দেখা দিবে, স্টোমাকে সমস্যা করবে, কিডনির সমস্যা করবে এবং এটি রাক্তের ভেতর গেলে ক্যান্সার আক্রান্ত করে।