পরিবেশবান্ধব শিল্পকারখানা স্থাপনে বাংলাদেশ সেরা
পরিবেশবান্ধব শিল্পকারখানা স্থাপনে বাংলাদেশ বেশ দ্রুতগতিতেই এগোচ্ছে। গত পাঁচ বছরে শুধু তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতে ১২৯টি পরিবেশবান্ধব কারখানা নির্মিত হয়েছে।
এর মধ্যে গত বছর, অর্থাৎ ২০২২ সালে হয়েছে ৩০টি। তবে সংখ্যাই যে শুধু বাড়ছে, তা নয়। সংখ্যার পাশাপাশি মানেও অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।
বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ১০০ পরিবেশবান্ধব শিল্পকারখানার মধ্যে অর্ধেক বা ৫০টিই বাংলাদেশের। এমনকি সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট পাওয়া তিন শিল্পকারখানার মধ্যে দুটিই বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের।
অবশ্য শীর্ষ স্থানটি ইন্দোনেশিয়ার পিটি ইউএনগ্রান সারি গার্মেন্টসের দখলে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বাংলাদেশের নাম প্রকাশ না করা একটি কারখানা। আর তৃতীয় স্থানে আছে বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের দুটি কারখানা—রেমি হোল্ডিংস ও ফতুল্লা অ্যাপারেলস।
সারা বিশ্বের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান পরিবেশবান্ধব স্থাপনার সনদ দিয়ে থাকে। তাদের মধ্যে একটি হলো যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি)। প্রতিষ্ঠানটি ‘লিড’ নামে পরিবেশবান্ধব স্থাপনার সনদ দিয়ে থাকে।
লিডের পূর্ণাঙ্গ রূপ ‘লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন’। সনদটি পেতে একটি প্রকল্পকে ইউএসজিবিসির তত্ত্বাবধানে নির্মাণ থেকে উৎপাদন পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে সর্বোচ্চ মান রক্ষা করতে হয়। ভবন নির্মাণের পরে কিংবা পুরোনো ভবন সংস্কার করেও ইউএসজিবিসির সনদের জন্য আবেদন করা যায়।
১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ইউএসজিবিসির অধীন কলকারখানার পাশাপাশি বাণিজ্যিক ভবন, স্কুল, হাসপাতাল, বাড়ি, বিক্রয়কেন্দ্র, প্রার্থনাকেন্দ্র ইত্যাদি পরিবেশবান্ধব স্থাপনা হিসেবে গড়ে তোলা যায়।
বিশ্বে গত বছরের নভেম্বরে লিড সনদ পাওয়া বাণিজ্যিক স্থাপনার সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে যায়। এই সনদ পেতে ৯টি শর্ত পরিপালন করতে হয়। মোট নম্বর ১১০ পয়েন্ট। এর মধ্যে ৮০ পয়েন্টের ওপরে হলে ‘লিড প্লাটিনাম’, ৬০-৭৯ পয়েন্ট হলে ‘লিড গোল্ড’, ৫০-৫৯ হলে ‘লিড সিলভার’ ও ৪০-৪৯ হলে ‘লিড সার্টিফায়েড’ সনদ মেলে।
বাংলাদেশের পরিবেশবান্ধব স্থাপনাগুলোর প্রায় সব কটিই ইউএসজিবিসির সনদ নিয়েছে। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের ২১০টি স্থাপনা লিড সনদ পেয়েছে।
এর মধ্যে ১৮৭টি পোশাক ও বস্ত্র খাতের কারখানা। এসব কারখানার মধ্যে ৬৩টি লিড প্লাটিনাম, ১১০টি গোল্ড, ১০টি সিলভার ও ৪টি সার্টিফায়েড সনদ পেয়েছে।
বাংলাদেশে পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তা সাজ্জাদুর রহমান মৃধার হাত ধরে ২০১২ সালে প্রথম পরিবেশবান্ধব কারখানার যাত্রা শুরু হয়। তিনি পাবনার ঈশ্বরদী ইপিজেডে স্থাপন করেন ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও।
তাঁর দেখানো পথ ধরে পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা ও বস্ত্রকলের ডাবল সেঞ্চুরি হতে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে রানা প্লাজা ধসের বড় ভূমিকা রয়েছে। ২০১৩ সালের এপ্রিলের ওই দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশের পোশাক কারখানার নিরাপত্তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে প্রশ্ন ওঠার পরপরই এই খাতের উদ্যোক্তারা পরিবেশবান্ধব কারখানা নির্মাণে আগ্রহী হন।
এর বাইরে শিপইয়ার্ড, জুতা, ও ইলেকট্রনিক পণ্য নির্মাণে রয়েছে পরিবেশবান্ধব কারখানা। এমনকি পরিবেশবান্ধব সুউচ্চ বাণিজ্যিক ভবনও হচ্ছে।
তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্যানুযায়ী, পরিবেশবান্ধব শীর্ষ ১০ কারখানার তালিকায় স্থান করে নেওয়া ১১টি (দুটি যৌথ অবস্থানে) শিল্প স্থাপনার মধ্যে ৯টিই বাংলাদেশের কারখানা।
বর্তমানে ১১০ পয়েন্টের মধ্যে ১০১ নিয়ে শীর্ষ স্থানে রয়েছে ইন্দোনেশিয়ার পিটি ইউএনগ্রান সারি গার্মেন্টস প্রিনগাপাস ৬ ও ৭। আর ১০০ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশের একটি কারখানা, যেটির নাম প্রকাশ করা হয়নি।
৯৭ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে বাংলাদেশের বিটপী গ্রুপের রেমি হোল্ডিংস ও ফতুল্লা অ্যাপারেলস। বিটপী গ্রুপের আরেকটি কারখানা তারাসিমা অ্যাপারেলস ৯৩ পয়েন্ট নিয়ে চতুর্থ অবস্থানে।
এর পরের অবস্থানে যেসব কারখানা রয়েছে, সেগুলো হচ্ছে বাংলাদেশের প্লামি ফ্যাশনস (পয়েন্ট ৯২), শ্রীলঙ্কার ব্র্যান্ডিক্স অ্যাপারেলস (৯২), বাংলাদেশের সিলকেন সুইং লিমিটেড-ভবন ১ (৯২), মিথিলা টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ (৯১), হ্যাবিটিউস ফ্যাশন (৯১), তারাসিমা অ্যাপারেলস (৯১)।
শীর্ষস্থানীয় ১০০ কারখানার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৫০টি বাংলাদেশের। চীনে ১০টি, পাকিস্তানে ৯টি, ভারতে ৬টি, শ্রীলঙ্কায় ৬টি, ভিয়েতনামে ৪টি, তাইওয়ানে ৪টি এবং মিয়ানমারে ২টি পরিবেশবান্ধব শিল্পকারখানা রয়েছে।
তা ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), ইন্দোনেশিয়া, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, মেক্সিকো, পোল্যান্ড, প্যারাগুয়ে, রোমানিয়া ও তুরস্কে একটি করে পরিবেশবান্ধব শিল্পকারখানা আছে।
এ বিষয়ে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদউল্লাহ আজিম বলেন, ‘পরিবেশবান্ধব কারখানা স্থাপনে বাংলাদেশ অনন্য জায়গায় পৌঁছে গেছে।
সে জন্য বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের পোশাকশিল্পকে এখন সমীহ করে। এই সমীহের সুফলও আমরা পাচ্ছি। বাণিজ্য যুক্ত, করোনা ও ভূরাজনৈতিক কারণে চীন থেকে সরে আসা ক্রয়াদেশের একটা ভালো অংশ বাংলাদেশ পাচ্ছে।’ পরিবেশবান্ধব কারখানার সুফল আগামী দিনগুলোতে আরও বেশি মিলবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।