বিলীন হয়ে যাচ্ছে শত শত ঝাউগাছ , দিন দিন সৌন্দর্য হারাচ্ছে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত
সৌন্দর্য হারাচ্ছে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত। বিলীন হয়ে যাচ্ছে সাগর পাড়ের শত শত ঝাউগাছ। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের সবুজ বেষ্টনী হিসেবে পরিচিত ঝাউবাগান আবারও সাগরের ভাঙনের কবলে পড়েছে।
সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ ও ‘পূর্ণিমার’ জোয়ারের কারণে সাগরের উত্তাল ঢেউয়ে সৈকতের কবিতা চত্বর এবং ডায়বেটিক পয়েন্টসহ বিভিন্ন এলাকায় বিলীন হয়ে গেছে শত শত ঝাউগাছ। এতে সৈকতের সৌন্দর্য্য হারানোর পাশাপাশি পরিবেশের ওপর বিশাল প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত প্রায় ১শ ২০ কিলোমিটার সমুদ্র সৈকতের পাশে সবুজ বেষ্টনীর মতো দাঁড়িয়ে আছে ঝাউগাছ, সমুদ্রসৈকতের পাশাপাশি পর্যটকদের অসাধারণ এই সৌন্দর্যের হাতছানি দিচ্ছে ঝাউবাগান।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সাগরের করাল গ্রাসে শহরের নাজিরারটেক, সমিতিপাড়া, চরপাড়া ও ডায়বেটিক হাসপাতাল এবং শৈবাল পয়েন্ট থেকে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত ঝাউবাগানে নেমে এসেছে বড় বিপর্যয়।
বিগত দুই বছরে এসব এলাকায় বিলীন হয়েছে প্রায় ৬ হাজার গাছ। এছাড়া পর্যটন স্পট হিমছড়ি, প্যাঁচারদ্বীপ, ইনানী বীচ, মনখালীসহ টেকনাফ পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় ভাঙন, নিধন ও দখলের কবলে পড়েছে ঝাউবাগান।
নাজিরারটেকের বাসিন্দা পরিবেশ সাংবাদিক হুমায়ুন সিকদার বলেন, ৮০ দশক থেকে সৈকতের বিভিন্ন অংশে ভাঙনের সৃষ্টি হচ্ছে। এতে প্রতিবছর বর্ষায় ভাঙন আরও বেড়ে যায়।
তিনি আরো বলেন, নাজিরারটেক থেকে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত চলমান ভাঙনে গত দুই বছরে স্থানভেদে এক কিলোমিটারেরও বেশি ঝাউগাছ বিলীন হয়ে গেছে। বিশেষ করে সমিতিপাড়া থেকে শৈবাল পয়েন্ট পর্যন্ত ঝাউগাছ নিধনে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ১শ ২০ কিলোমিটার লম্বা সাগর তীরের অপরূপ এবং নয়নাভিরাম দৃশ্যের রাণী সৈকতে গত চার দশকে ভাঙনে প্রায় সাড়ে ৫ লাখেরও বেশি গাছ বিলীন হয়ে গেছে।
অন্যদিকে, এসব ঝাউবাগান দখল করে সেখানে অবৈধ বসতবাড়ি গড়ে তোলায় দিন দিন সৌন্দর্য হারাচ্ছে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত। শুধু দখল নয় বরং এসব অবৈধ দখলদারদের শিকারে পরিণত হয়ে প্রতিদিন ধংস হচ্ছে শত শত ঝাউগাছ।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৪ সালের পর থেকে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতজুড়ে প্রায় ৭ লাখ চারা রোপণ করা হয়েছে। কিন্তু ভাঙন ও অসাধু ব্যক্তিদের দ্বারা গাছ নিধনের কারণে এখন গাছের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাএ ২০ হাজারে। এতে উদ্বিগ্ন বন বিভাগও।
কক্সবাজার বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. হুমায়ন কবির বলেন, ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’র প্রভাবে সৈকতের বিভিন্ন এলাকায় তিন শতাধিক গাছ বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৩ হেক্টর বাগান। যেখানে চারা গাছ রয়েছে।
কক্সবাজার দক্ষিণ এবং উপকূলীয় বনাঞ্চল মিলে ২৩ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানান তিনি।
ডিএফও (DFO) হুমায়ুন কবির আরও বলেন, বর্ষা মৌসুমে কক্সবাজার কস্তুরাঘাট ও হিমছড়ি এবং উখিয়ার ইনানী মনখালী এলাকায় নতুন করে ৩৫ হেক্টর বনায়ন করা হবে। এছাড়াও যেখানে যেখানে গাছ মারা গেছে, কেটে ফেলেছে বা গাছ নেই সেসব শূন্যস্থানে ৬০ হাজার চারা রোপণ করা হবে। এরমধ্যে কস্তুরাঘাট থেকে হিমছড়ি পর্যন্ত ৩৫ হাজার এবং ইনানী রেজুখাল থেকে পাটুয়ারটেক পর্যন্ত ২৫ হাজার চারা রোপণ করা হবে।
তবে, যেসব এলাকাগুলোতে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে অবস্থানগত কারণে সেখানে আপাতত আর চারা লাগানো যাবে না বলে জানিয়েছেন তিনি। পরিবেশবিদরা বলছেন, ঝাউবাগানের ভেতরে এক ধরনের বেসিনের মত গর্ত তৈরি হয়, যেখানে পানি জমে থাকে। জমে থাকা এসব পানি ভাঙ্গনকে তরান্বিত করে। তাই ভাঙ্গনরোধে ঝাউবনের পাশাপাশি নারিকেলসহ অধিক শেকড়যুক্ত গাছ যেগুলো উপকূলীয় এলাকায় হয়, এ ধরনের গাছ লাগাতে হবে।
কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক শেখ মোহাম্মদ নাজমুল হুদা বলেন, বিভিন্ন সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় পানি ওভারফুল হচ্ছে। সৈকতে পর্যটকদের অবাধ বিচরণ ও কিছু অসাধু লোকজন সৈকতের বালিয়াড়ি থেকে লতাপাতা কেটে নিয়ে যাওয়ায় কারণে সৈকতের বালিয়াড়ি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
সমুদ্রসৈকতে বালিয়াড়িগুলোকে অনেকে আঁকড়ে ধরে রাখে সৈকত লতা, নিশিন্দাসহ গুল্ম জাতীয় লতা ও ঝোঁপগুলো। কিন্তু দিন দিন এসব লতাপাতা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় সমুদ্রসৈকতে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে বলে যোগ করেন, নাজমুল হুদা।
পরিবেশ অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ভাঙনের কারণে একদিকে যেমন সৈকতের সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে অন্যদিকে সাগর লোকালয়ের দিকে চলে যাওয়ায় কমে আসছে মূল ভূ-খণ্ড। এছাড়া স্বাভাবিক সৈকত না থাকলে সামুদ্রিক কচ্ছপ ও লাল কাঁকড়াসহ সকল ধরনের প্রাণীগুলো আবাসস্থল হারাচ্ছে। ফলে মুখে পড়ছে জীববৈচিত্র্য।