প্রকৃতির অদ্ভুত আচরণে বিপর্যস্ত পরিবেশ
ভারত, পাকিস্তানে যখন বন্যা, তখন দাবানলে পুড়ছে ইউরোপ। আবার চীনের এক পাশ যখন খরায় পুড়ছে, অন্য পাশ তখন বন্যায় প্লাবিত। বাংলাদেশেও প্রকৃতির আচরণ বোঝা দায়। এই খরা তো এই বন্যা।
বর্ষায় বৃষ্টির দেখা পাওয়া ভার। শরৎকালে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে যাওয়ার বদলে ক্ষণে ক্ষণে কালো মেঘে ঢেকেছে আকাশ। বর্ষার বৃষ্টি ঝরেছে শরতে। দুপুরবেলা কটকটে রোদে শরীর যখন ঘামছে, সন্ধ্যাবেলাতে আবার তখন শীত শীত অনুভূতি।
প্রকৃতির এমন অদ্ভুত আচরণে বিপর্যস্ত মানুষ। আর এই মানুষই প্রকৃতিকে এমন করে তুলেছে। সেই কবে রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন, ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর, লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর’।
এরপরও কেটেছে কত যুগ। অরণ্য আর ফেরেনি। বেড়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন। বেড়েছে জলবায়ুর উষ্ণতা। গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন। আর এত সব গ্যাঁড়াকলে প্রকৃতি ভুলেছে তার নিয়ম। প্রকৃতি এখন তাই এমন পাগলাটে।
গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণে পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর বড় ভূমিকা রয়েছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক জলবায়ুবিষয়ক ওয়েবসাইট কার্বন ব্রিফ বলছে, কার্বন নিঃসরণে প্রথমে রয়েছে কানাডা। এরপর যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া।
তবে এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে এশিয়ার দেশগুলোয়। হঠাৎ আসা প্রবল বর্ষণে এ বছর বিপর্যস্ত হয়েছে দক্ষিণ এশিয়া। গত মে ও জুনে বাংলাদেশ ও ভারত বন্যার কবলে পড়ে।
কিছুদিন আগের বন্যায় পাকিস্তানে দেড় হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে কমপক্ষে পাঁচ লাখ মানুষ বাড়িঘর হারিয়েছে। দেশটির এক-তৃতীয়াংশ পানিতে তলিয়ে গেছে।
পাকিস্তানে বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বন্যার জন্য গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণকে দায়ী করেছেন। এক সংবাদ সম্মেলনে গুতেরেস বলেন, ‘আমরা প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছি। এখন প্রকৃতিও পাল্টা প্রতিশোধ নিচ্ছে। এসব কারণে ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।’
এএফপির প্রতিবেদনে পাকিস্তানে এমন বন্যার কারণ সম্পর্কে বলেছেন ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের গ্রানথাম ইনস্টিটিউটের জলবায়ুবিজ্ঞানের শিক্ষক ফ্রেডরিক ওটো। তিনি বলেন, পাকিস্তানের ঐতিহাসিক নথিপত্রে দেখা যায়, মানুষ বায়ুমণ্ডলে প্রচুর পরিমাণে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত করা শুরু করার পর থেকে এ অঞ্চলে বৃষ্টি বেড়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশগুলো যখন বন্যাপ্লাবিত, তখন মধ্যপ্রাচ্য আরও বেশি উষ্ণ হচ্ছে। আগামী নভেম্বরে মিসরে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জাতিসংঘের কপ ২৭ জলবায়ু সম্মেলন।
এই সম্মেলনকে সামনে রেখে রিভিউস অব জিওফিজিক্স সাময়িকীতে প্রকাশিত হালনাগাদ গবেষণা প্রতিবেদনে গবেষকেরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে প্রতি দশকে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার শূন্য দশমিক ৪৫ ডিগ্রি। আর এ সময়ের মধ্যে প্রতি দশকে বিশ্বে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার শূন্য দশমিক ২৭ ডিগ্রি।
১৯৮১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এ পরিসংখ্যান উপস্থাপন করা হয়েছে। মিসর, লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, বাহরাইন, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইরানকে গবেষণার আওতায় রাখা হয়েছিল।
গবেষণায় দেখা গেছে, মধ্যপ্রাচ্য যে শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা-ই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও অঞ্চলটির বড় ধরনের দায়ও আছে। তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য বিশ্বে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের অন্যতম একটি উৎসে পরিণত হওয়ার পথে আছে। গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের দিক থেকে কয়েক বছরে অঞ্চলটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্থান দখল করে নেবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যে শুষ্কতা বাড়ার পাশাপাশি ইউরোপে বাড়ছে গরম। চোখ রাঙাচ্ছে দাবানল। এ বছর গ্রীষ্মের দাবদাহে দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপ পুড়েছে দাবানলে। ফ্রান্স, পর্তুগাল, স্পেন ও গ্রিসের হাজার হাজার হেক্টর এলাকা ধ্বংস হয়েছে দাবানলে। দাবানলে মারা গেছে কয়েক শ মানুষ। গরমের কারণে যুক্তরাজ্যে জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়।
চীনের আবহাওয়া পরিস্থিতি তো অদ্ভুতুড়ে। এ বছরের জুন থেকে আগস্ট মাসে চীন একদিকে বন্যায় ডুবেছে, আবার অন্যদিকে খরায় পুড়েছে। এ সময় চীনের দক্ষিণাঞ্চলের গুয়াংজুতে প্রবল বন্যা হয়।
সেই পরিস্থিতির মধ্যেই দেশটির মধ্য ও উত্তরাঞ্চলে তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বেড়েছে। এর কিছুদিন পর তীব্র দাবদাহের কারণে চীনে ‘হলুদ সতর্কতা’ বা ইয়েলো অ্যালার্ট জারি করা হয়।
ওই সময় জাতীয় জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল গ্রহণ সম্পর্কে চীনা সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তন চীনের প্রাকৃতিক পরিবেশের ব্যবস্থায় মারাত্মক বিরূপ প্রভাব নিয়ে এসেছে।
বন উজাড়, জলাভূমি ভরাট, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সেচের জন্য পানি জমানোর তো কর্মকাণ্ডের কারণে বন্যার ঝুঁকি বেড়েছে।