জ্বালানি সংকটে বিকল্প এখন কয়লা
ইউক্রেইনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হওয়ার চতুর্থ মাসের মধ্যেই বিশ্বব্যাপী কয়লার চাহিদা ১১গুণ বেড়ে গেছে। কয়লাকে বলা হয় সবচেয়ে বেশি পরিবেশ দূষণকারী জীবাশ্ম জ্বালানি। যেটির ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধে একবছর আগেও নানা উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলা হচ্ছিল। এখন সেই কয়লার খোঁজে ছুটছে নানা দেশ, হু হু করে বাড়ছে দাম।
পূর্ব আফ্রিকার দেশ তানজানিয়ার মাতওয়ারা বন্দর দিয়ে গত বছরের শেষভাগ পর্যন্তও খুব বেশি জাহাজ চলাচল করতো না। ছিলো না কোনো ব্যস্ততা। ওই বন্দর দিয়ে মূলত কাজুবাদামের চালান যেত।
কিন্তু ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বন্দরের দৃশ্যপট পুরোপুরি পাল্টে গেছে। ঘুমন্ত বন্দরটি যেন হঠাৎ করে পুরোপুরি সজাগ হয়ে উঠেছে। একের পর এক কয়লা বোঝাই জাহাজ মাতওয়ারা বন্দর থেকে ছেড়ে যাচ্ছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে রুশ বাহিনী ইউক্রেইনে আগ্রাসন শুরু করলে শাস্তি হিসেবে পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার সব ধরনের জ্বালানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলে বিশ্ববাজারে রাশিয়ার জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, রেকর্ড উচ্চতায় উঠে যায় জ্বালানির দাম।
যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পুরো বিশ্বে। বিশেষ করে রাশিয়ার গ্যাস ও কয়লার উপর নির্ভরশীল ইউরোপ পড়েছে সবচেয়ে বেশি বিপদে। ইউরোপের দেশগুলো এখন চাহিদা মেটাতে বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে জ্বালানি পণ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করছে।
তানজানিয়া এতদিন সাধারণত পূর্ব আফ্রিকার প্রতিবেশী দেশগুলোতে থার্মাল কয়লা রপ্তানি করত। প্রতিবেশী দেশগুলোর বাইরে কয়লা রপ্তানির কথা এতদিন তানজানিয়া সরকার চিন্তাও করতে পারতো না।
কারণ, দেশটির দক্ষিণপশ্চিমের খনিগুলো থেকে সবচেয়ে কাছের বন্দর মাতওয়ারায় কয়লা আনতেও তাদের ছয়শ কিলোমিটারের বেশি সড়কপথ পাড়ি দিতে হয়। তানজানিয়ার মাতওয়ারা বন্দর ভারত মহাসাগরে।
থার্মাল কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার হয়। জ্বালানির অভাবে পুরো বিশ্বেই এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন সংকটে পড়েছে। যার ফলে কয়লার চাহিদা বেড়ে গেছে। ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে থার্মাল কয়লার দাম রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে।
ইউরোপ এবং অন্যান্য দেশের ক্রেতারা এখন তানজানিয়া, বতসোয়ানা এমনকি মাদাগাস্কারের মত দেশগুলোর অপেক্ষাকৃত দুর্গম কয়লা খনি থেকেও উচ্চমূল্যে কয়লা কিনতে রাজি আছে। এই যে কয়লার চাহিদা পুনরায় বেড়ে যাওয়া, তা এক বছর আগেও করা জলবায়ু পরিকল্পনার সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক।
বিভিন্ন দেশের সরকার এখন রাশিয়ার জ্বালানির উপর নির্ভরতা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে চাইছে। এদিকে বিদ্যুতের বাড়তে থাকা দামের উপরও লাগাম টানার চেষ্টা করছে। এজন্য তারা আবারও সবচেয়ে বেশি পরিবেশ দূষণকারী জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
কার্গিলের সমুদ্র পরিবহন বিভাগের প্রেসিডেন্ট জন ডিলেমান বলেন, ‘ইউরোপ এখন অন্যান্য ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামছে। বিকল্প জ্বালানি গ্যাস অনেক বেশি ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে।
ইউরোপকে এখন অবশ্যই কয়লার উৎস খুঁজে পেতে হবে এবং আমরা শিগগিরই কলম্বিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা এমনকি আরো দূরের দেশ থেকেও ইউরোপে অনেক বেশি কয়লার চালান যেতে দেখতে পাব।’
যদিও ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি যে কোনো সময় পরিবর্তন হতে পারে। ফলে কয়লার চাহিদা বেড়ে যাওয়া এবং উচ্চমূল্যে তা বিক্রির সুযোগ খুব বেশি দিন নাও থাকতে পারে। তারপরও কয়লা সমৃদ্ধ দেশগুলো একে তাদের জন্য খুব ভালো সুযোগ হিসেবে দেখছে, যে সুযোগ তারা হাতছাড়া করতে চায় না।
চাহিদা বেড়ে যাওয়া এবং যোগান স্বল্পতার কারণে কয়লা নিয়ে আবারও বাণিজ্যের পথ খুলেছে। ব্রেমার রিসার্চের তথ্যানুযায়ী, গত জুলাই মাসে বিশ্বব্যাপী জীবাশ্ম এ জ্বালানির চাহিদা এবং যোগান রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখন অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে থার্মাল কয়লা আমদানি করছে। আগে যেগুলো এশিয়ার বাজারে যেত। ইউক্রেইনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হওয়ার চতুর্থ মাসেই বিশ্বব্যাপী কয়লার চাহিদা ১১গুণ বেড়ে গেছে।