তহবিল সংকটে উন্নয়নশীল দেশগুলো জলবায়ু মোকাবেলায় স্থবির হয়ে পড়েছে
তহবিল সংকটে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জলবায়ু-সংক্রান্ত কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। ২০২০ সাল থেকে প্রতিবছর জলবায়ু অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েও উন্নত দেশগুলো অর্থ দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
চলতি বছর জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর উচিত হবে এ অর্থ সরবরাহে একটি রোডম্যাপ ঘোষণায় উন্নত দেশগুলোকে রাজি করানো।
কপ ২৭-সামনে রেখে ইউক্রেন যুদ্ধপ্রসূত অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক ও জ্বালানি সংকট মোকাবিলার বাধ্যবাধকতার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চ্যালেঞ্জগুলোর ওপর প্রাধান্য অব্যাহত রাখতে হবে উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এই বিবৃতি দেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, প্যারিস চুক্তিতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে প্রতিশ্রুত জলবায়ু তহবিল দিতে ঐচ্ছিক রাখা, করোনার প্রভাব এবং ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের ফলে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম এবং উন্নত দেশের সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় তহবিল সংকটের কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জলবায়ু অভিযোজন ও প্রশমন কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ইতোমধ্যে প্রাক-শিল্প যুগ থেকে ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ায় বিশ্বব্যাপী ঘনঘন বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ও দাবানলের ঘটনা বেড়েছে। অথচ কার্বন নিঃসরণকারী জীবাশ্ম জ্বালানি, বিশেষ করে কয়লার ব্যবহার ও রফতানি বেড়েছে। কয়লাভিত্তিক জ্বালানি প্রকল্পে অর্থায়নও বেড়েছে।
এ রকম একটি বৈশ্বিক পরিস্থিতিকে সামনে রেখে মিশরের শার্ম আল শেখে ইউনাইটেড ন্যাশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জের ২৭তম সভা বা কনফারেন্স অব পার্টিজ (কপ২৭) অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও ২০২০ সাল থেকে প্রতিবছর জলবায়ু অর্থায়ন হিসেবে ১০০ বিলিয়ন ডলার দিতে উন্নত দেশগুলো ব্যর্থ হয়েছে, যা বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস লক্ষ্যমাত্রা অর্জনসহ প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত।
জলবায়ু তহবিল ‘উন্নয়ন সহায়তার বাড়তি’ এবং ‘নতুন ও অতিরিক্ত’ হলেও কোনও রকম যাচাই-বাছাই ছাড়াই উন্নয়ন সহায়তার সঙ্গে জলবায়ু অর্থায়নকে মিলিয়ে গত দুই বছরে তারা মাত্র ৮৩.৩ বিলিয়ন দিয়েছে, যার মধ্যে সর্বোচ্চ ২০ বিলিয়ন ডলার জলবায়ু তহবিল।
উন্নত দেশগুলোর বাধার কারণে ২০২১ সালের জলবায়ু সম্মেলনে ক্ষয়-ক্ষতি মোকাবিলায় আলাদা তহবিল গঠন করা সম্ভব হয়নি। উপরন্তু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতে খাদ্য-নিরাপত্তা, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণসংক্রান্ত কার্যক্রমে তারা সহায়তা কমিয়ে দিয়েছে।
তাই সার্বিক বিবেচনায় প্যারিস চুক্তির আলোকে জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন, প্রশমন ও অর্থায়নকে গুরুত্ব দিয়ে আসন্ন সম্মেলনে বাংলাদেশসহ অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে তাদেরই স্বার্থে জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে।’
আসন্ন কপ২৭ সম্মেলনে জলবায়ু অর্থায়নে দৃশ্যমান অগ্রগতিসহ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতসহ প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়ন নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের বিবেচনার জন্য টিআইবি ‘বাংলাদেশ কর্তৃক কপ২৭ সম্মেলনে উত্থাপনযোগ্য’ ও ‘বাংলাদেশ সরকারের করণীয়’ দুইভাগে মোট ১৬টি দাবি পেশ করছে।
যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করে উন্নত দেশগুলোকে ২০২০-২০২৫ মেয়াদের প্রতিশ্রুত মোট ৬০০ বিলিয়ন ডলার দিতে একটি সময়াবদ্ধ রোডম্যাপ প্রস্তুতে সমন্বিত দাবি উত্থাপন করতে হবে।
জিসিএফসহ জলবায়ু তহবিলে ঋণ নয়, অভিযোজনকে অগ্রাধিকার দিয়ে ক্ষতিপূরণের টাকা অনুদান হিসেবে দিতে হবে। ক্ষয়-ক্ষতিবিষয়ক আলাদা তহবিল গঠন করতে হবে এবং ঝুঁকি বিনিময়ে বিমার পরিবর্তে অনুদানভিত্তিক অর্থ দিতে হবে।
বাংলাদেশ সরকারের করণীয়
ইউক্রেন যুদ্ধপ্রসূত অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক ও জ্বালানি সংকট মোকাবিলার বাধ্যবাধকতার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চ্যালেঞ্জগুলোর ওপর প্রাধান্য অব্যাহত রাখতে হবে, জীবন-জীবিকা, বন ও পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ ঝুঁকিপূর্ণ শিল্পায়ন কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে স্থগিত করে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ কৌশলগত পরিবেশের প্রভাব নিরূপণ সাপেক্ষে অগ্রসর হতে হবে; একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপসহ প্রস্তাবিত ইন্ট্রিগ্রেটেড এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার মাস্টার প্ল্যান-আইইপিএমপিতে কৌশলগতভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে গুরুত্ব দিতে হবে, বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন বাড়াতে এ খাতে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি সময়াবদ্ধ পরিকল্পনা নিতে হবে; জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা সংক্রান্ত সব প্রকল্পে সুশাসন, শুদ্ধাচার ও বিশেষ করে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে।