জীববৈচিত্র্য রক্ষায় একমত বিশ্ব নেতারা
মন্ট্রিয়লে কপ-১৫ সম্মেলনে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সবাই মতৈক্যে পৌঁছেছে। লক্ষ্যমাত্রা ঠিক হয়েছে। তবে অর্থায়ন নিয়ে ধনী ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মতপার্থক্য রয়ে গেছে।
কানাডার মন্ট্রিয়লের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত প্যালে ডে কংগ্রেস কনভেনশন সেন্টারের বাইরে তখন বেশ তুষারপাত হচ্ছিল। বাইরে তীব্র ঠান্ডা থাকলেও ভেতরে কপ-১৫ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশের প্রতিনিধিদের আলোচনায় বেশ উত্তাপ ছড়াচ্ছিল। মতৈক্যে পৌঁছাতে তাঁরা এক বৈঠক থেকে অন্য বৈঠকে যাচ্ছিলেন।
দিন গড়িয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত আলোচনা চলতে থাকে। অনেক দর-কষাকষির পর স্থানীয় সময় রবিবার ভোররাতে বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্য ফ্রেমওয়ার্ক চূড়ান্ত করেন তাঁরা। ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর এক–তৃতীয়াংশ রক্ষায় সবাই সম্মত হন।
আলোচনায় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল—জীববৈচিত্র্য ফ্রেমওয়ার্ক কতটা উচ্চাভিলাষী হওয়া উচিত, কীভাবে অর্থায়ন করা হবে এবং কীভাবে অগ্রগতি মূল্যায়ন ও স্বচ্ছ প্রতিবেদন নিশ্চিত করা যায়।
চীনের সভাপতিত্বে কানাডায় আয়োজিত সম্মেলনে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ২০৩০ সালের মধ্যে চারটি অভীষ্ট ও ২৩টি লক্ষ্যমাত্রা–সংবলিত ফ্রেমওয়ার্ক গ্রহণ করা হয়েছে।
চীন প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের একটি বড় পরিবেশ চুক্তিতে নেতৃত্ব দিয়েছে। চীনের কুনমিং শহরে সম্মেলন শুরু হয়েছিল। পরে কোভিড–১৯ বিধিনিষেধের কারণে সম্মেলন কানাডার মন্ট্রিয়ল শহরে স্থানান্তর করা হয়।
২৩টি লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ ভূমি ও জলভাগ সংরক্ষণ। বর্তমানে ১৭ শতাংশ ভূমি ও ১০ শতাংশ সামুদ্রিক অঞ্চল সুরক্ষিত। ২০৩০ সালের মধ্যে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বিভিন্ন উৎস থেকে ২০০ বিলিয়ন ডলার জোগাড় এবং প্রকৃতির জন্য ক্ষতিকর ৫০০ বিলিয়ন ডলারের ভর্তুকি সংস্কারের কথা বলা হয়েছে।
অর্থায়ন প্যাকেজের অংশ হিসেবে ২০২৫ সালের মধ্যে দরিদ্র দেশগুলোকে বছরে কমপক্ষে ২০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার আশ্বাস রয়েছে। বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে এই অর্থায়ন প্রতিবছর ৩০ বিলিয়ন ডলার করে বাড়বে।
কীটপতঙ্গের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, প্লাস্টিক বর্জ্যে সমুদ্রে লবণাক্ততা বাড়ছে, পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদের অত্যধিক ব্যবহার হচ্ছে, জনসংখ্যা ৮oo কোটি ছাড়িয়েছে এবং কিছু মানুষ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে—এমন এক বাস্তবতায় মন্ট্রিয়লে এই সমঝোতা হয়েছে।
এই লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়িত হলে কৃষি, ব্যবসার সরবরাহব্যবস্থা এবং পরিবেশ সংরক্ষণে আদিবাসী সম্প্রদায়ের ভূমিকায় বড় পরিবর্তন আসতে পারে।
বিশ্বের শুধু দুটি দেশ—ভ্যাটিকান ও যুক্তরাষ্ট্র জীববৈচিত্র্য–সম্পর্কিত জাতিসংঘ সম্মেলনে যোগ দেয়নি। ওয়াশিংটন ৩০ বছরের পুরোনো এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ১৯৯৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু তখনকার সিনেট এটি অনুমোদন করেনি।
এটা লজ্জা ও উদ্বেগজনক। প্রকৃতির প্রতি প্রতিশ্রুতি রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি বিশেষ জীববৈচিত্র্য দূত নিয়োগ দিয়েছে। মন্ট্রিয়লে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের এই দূতকে ‘প্রভাবক’ ভূমিকায় দেখা গেছে।
ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) উত্তর বিশ্বের প্রধান খেলোয়াড়ের ভূমিকায় ছিল। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনের মতো সমালোচনা ও ভণ্ডামির অভিযোগ থেকে রেহাই পেয়েছিল।
১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ধরিত্রী সম্মেলনে জীববৈচিত্র্য কনভেনশন গৃহীত হয়। ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে নির্দিষ্টসংখ্যক দেশ স্বাক্ষরের পর আন্তর্জাতিক চুক্তিটি কার্যকর হয়।
এই চুক্তিতে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, জীববৈচিত্র্যের উপাদানের টেকসই ব্যবহার এবং জেনেটিক সম্পদ ব্যবহার থেকে প্রাপ্ত সুবিধা সমানভাবে ভাগ করার কথা বলা হয়েছিল। এযাবৎ ১৯৬টি দেশের স্বাক্ষরের মাধ্যমে এই চুক্তি মোটামুটি সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
প্রতিটি দেশ এবং এতে অংশগ্রহণকারী অন্য অংশীজনেরা যা চেয়েছিল, মন্ট্রিয়ল সম্মেলনে তার কিছুটা হলেও পেয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে উচ্চাকাঙ্ক্ষায় ঘাটতি লক্ষণীয়। ২০৫০ সালের সময়সীমা যথেষ্ট উচ্চাভিলাষী নয়।
কেউ কেউ ভর্তুকির বিষয়ে কঠোর অবস্থান চেয়েছিলেন। ভর্তুকির কারণে বিশ্বের অনেক অঞ্চলে খাদ্য ও জ্বালানি অনেক সস্তা। সমঝোতায় শুধু ২০২৫ সালের মধ্যে ভর্তুকি চিহ্নিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এরপর ২০৩০ সালের মধ্যে সেগুলো সংস্কার বা পর্যায়ক্রমে কমানো ও বন্ধ করার জন্য কাজ করা যেতে পারে।
২০৩০ সালের মধ্যে প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র ৫ শতাংশ বৃদ্ধির বিষয়টি চূড়ান্ত লক্ষ্যমাত্রায় স্থান পায়নি। একে একটি বড় সুযোগ হাতছাড়া বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ, নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা না থাকলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হারিয়ে যায়।
পশ্চিমা ধনী দেশগুলোর ভোগ মোকাবিলায় লক্ষ্যমাত্রা নেই। তাদের এই ভোগব্যবস্থা ব্যাপকভাবে সীমিত সম্পদ গ্রাস করছে। পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে কার্বন উৎপাদন করছে।
সিনথেটিক বায়োলজি ও বায়োটেকনোলজির সমস্যা নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থার উত্থাপিত বেশ কয়েকটি উদ্বেগ অমীমাংসিত রয়ে গেছে।
উদাহরণস্বরূপ, সিনথেটিক বায়োলজির দিগন্ত স্ক্যানিং, প্রযুক্তি মূল্যায়ন ও নিরীক্ষণ, আর্থসামাজিক প্রভাব যাচাই এবং জিন ড্রাইভের ওপর বিশ্বব্যাপী স্থগিতাদেশ–সংবলিত কোনো জৈবপ্রযুক্তি–সম্পর্কিত লক্ষ্যমাত্রা নেই।
সদস্যদেশগুলোর অগ্রগতি প্রতিবেদন যাচাই করতে জলবায়ু পরিবর্তন–সংক্রান্ত প্যারিস চুক্তির অনুরূপ একটি শক্তিশালী ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি৷
৩০x৩০ (সংরক্ষিত বনাঞ্চল বোঝাতে ব্যবহার করা হয়) একটি শিরোনাম। কিন্তু এটি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রক্রিয়া ছাড়া অর্জন করা যাবে না।
জীববৈচিত্র্য রক্ষার কোনো পদক্ষেপে আদিবাসীদের ওপর অভিঘাত ফেলে এমন কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে আগে তাদের সম্মতি থাকতে হবে। অন্যথায় সংরক্ষিত এলাকায় আদিবাসীদের বাস্তুচ্যুত হওয়ার একই পুরোনো প্রবণতা অব্যাহত থাকবে।