জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার নির্গমন কমানোর বিষয়ে কার্যকর উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্ত নিতে হবে
মিসরের শার্ম আল-শেখ পর্যটনকেন্দ্রে রোববার শুরু হয়েছে জলবায়ু সম্মেলন। ১২০টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান এবং ১৯৮টি দেশের কূটনীতিকদের পাশাপাশি পর্যবেক্ষক হিসেবে প্রায় ৩০ হাজার প্রতিনিধি দুই সপ্তাহের এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করছেন।
এর মধ্যে ব্যক্তি খাত, গবেষক, নাগরিক সমাজ ও সামাজিক আন্দোলনের বিভিন্ন সংগঠন-প্রতিষ্ঠানের নেতারাও রয়েছেন। সম্মেলনে তিনটি ধারায় আলোচ্য বিষয় বা এজেন্ডা দুই ডজনেরও বেশি।
জলবায়ু পরিবর্তন একটি পূর্বানুমান থেকে নিষ্ঠুর বাস্তবতায় পরিণত হওয়ার প্রেক্ষাপটে ২০০৭ সালে সূচিত আলোচনা ২০১৫ সালে একটি পরিণতিতে পৌঁছে প্যারিস চুক্তি সম্পাদনের মধ্য দিয়ে।
যদিও বালি কর্মপরিকল্পনা নামে নতুন পর্যায়ের ওই আলোচনা শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০০৯ সালে। আলোচনা বিলম্বিত হয় মূলত ঐতিহাসিকভাবে বৃহৎ পরিমাণে ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমনকারী দেশগুলোর সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে বৃহত্তম নির্গমনকারী দেশগুলোর মধ্যে কোনো ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায়।
মানবসমাজ সম্মিলিতভাবে এবং বিশেষত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তিতে পৌঁছাতে গিয়ে আগের আট বছরে হারিয়েছে অতীত অর্জনের অনেক কিছু।
প্রথমত, ১৯৯২ সালে বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন কাঠামো সনদ নামে যে ঐতিহাসিক চুক্তিতে উপনীত হয়েছিল, তা সাধারণ কিন্তু পৃথকীকৃত দায় ও সংশ্নিষ্ট সক্ষমতার
(কমন বাট ডিফারেনশিয়েটেড রেসপনসিবিলিটিস অ্যান্ড রেসপেকটিভ ক্যাপাবিলিটিস) ভিত্তিতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দেশগুলোর ভূমিকা ও করণীয় নির্ধারণের নীতি ঘোষণা করেছিল।
কাঠামো সনদের এই নীতির অধীনে ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল কিয়োটো প্রটোকল। এই চুক্তির আকর্ষণীয় বিষয় ছিল, এতে নির্গমনের জন্য দায়ী দেশগুলোর একটি তালিকা করা হয়।
এর অধীনে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনকারী দেশগুলো তাদের নির্গমন কমানোর লক্ষ্য স্থির করে। প্রটোকলে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর আইনগত বাধ্যবাধকতা ছিল তা মেনে চলার।
দুঃখজনক হলেও সত্য, ২০০৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে চুক্তি বাস্তবায়ন করার কথা থাকলেও মেয়াদান্তে কোনো দেশ ক্ষতিকর গ্যাসের নির্গমন কমায়নি। চুক্তিভঙ্গের অপরাধে তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া যায়নি, কারণ তাদের গায়ের জোর বেশি।
ক্ষমতাধর দেশ হিসেবে তারা পরে ‘সেকেন্ড কমিটমেন্ট পিরিয়ড’ নামে আরও একটি দায়বদ্ধতাকাল নির্ধারণ করে। এখানে সম্মিলিতভাবে তারা যতটুকু নির্গমন কমানোর অঙ্গীকার করে, তা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকাই রাখছে না।
অন্যদিকে ২০০৭ সালে সূচিত আলোচনা ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তিতে উপনীত হলেও এ চুক্তিতে সব সদস্য দেশকে নির্গমন কমানোর অঙ্গীকার করতে হয়েছে।
দায়ী দেশগুলোর ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা ভাগ করে দেওয়া হয়েছে সব দেশের ওপর। আর এজন্য দায়ী মূলত ভারত-চীনের মতো উন্নয়নশীল দেশসহ অতি উন্নত ধনী দেশগুলো। প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী সব দেশ নির্গমন কমানোর জন্য জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান শিরোনামে অঙ্গীকার করে।
এখানেও দুঃখজনক সত্য হলো, সব দেশ তাদের এই অঙ্গীকার পালন করলেও জলবায়ু পরিবর্তন পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হবে না।
উপরন্তু, কিয়োটো প্রটোকল পালনের আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকলেও যেখানে সদস্য দেশগুলো তাদের অঙ্গীকার পূরণ করেনি, সেখানে প্যারিস চুক্তির জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদানের অঙ্গীকার পূরণেরও কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ প্যারিস চুক্তি পালনের কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই।
ফলে প্যারিস চুক্তির মধ্য দিয়ে মানবজাতি তাদের অতীত অগ্রসরমানতা থেকে পিছিয়ে গেছে। দোষীদের দায়ভার চাপানো হয়েছে সবার ওপর, নির্গমন কমানোর অঙ্গীকার ঐচ্ছিক বা কোনো সূত্রের অধীন নয়। অঙ্গীকার বা চুক্তি পালনের আইনগত দায়বদ্ধতাও নেই।
এ রকম পরিস্থিতিতে কপ-২৭ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর দুই ডজন এজেন্ডার বেশিরভাগই অর্থহীন কিয়োটো প্রটোকল ও দুর্বল প্যারিস চুক্তির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। কাঠামো সনদের অধীনে আলোচনা চলমান আছে কয়েকটি বিষয়ে।
কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার প্রধান বিষয় নির্গমন কমানোর বিষয়ে কার্যকর উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে এসব আলোচনা ক্ষতিকর দেশ ও মানবজাতির জন্য খুব একটা কাজে আসবে না।
নির্গমন উল্লেখযোগ্য হারে না কমিয়ে ক্ষতিকর দেশগুলোকে ছিটেফোঁটা সহায়তা দেওয়ার অঙ্গীকার করে জলবায়ু পরিবর্তন পরিস্থিতির উন্নতি তো হবেই না, বরং অবনতি হবে।
সুতরাং কূটনীতিক ও সরকারি কর্মকর্তারা এজেন্ডা আইটেমের বিষয়গুলোতে মনোযোগ দিতে পারেন। তা করতে হবে রুটিন ওয়ার্ক হিসেবে। কিন্তু রাজনীতিবিদ নেতৃত্বকে গুরুত্ব দিতে হবে কীভাবে দায়ী দেশগুলো অধিক পরিমাণে নির্গমন কমাবে সে বিষয়ে। বাংলাদেশকে এ বিষয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে।
পাশাপাশি, রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় যে বিষয়টিতে জোর দিতে হবে তা হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে বাস্তুচ্যুতদের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, নির্গমনে দায়ী বিশেষ করে ধনী দেশগুলো কী করবে সে বিষয়ে।
এই দুটি প্রধান বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থান স্পষ্ট। তিনি অতীতে এগুলো নিয়ে কথা বলেছেন। মিসরে আসা বাংলাদেশের রাজনীতিকদের কর্তব্য, খুচরো বিষয়ে নজর না দিয়ে এই দুই রাজনৈতিক অগ্রাধিকারকে এগিয়ে নেওয়া।
আশার কথা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর ক্ষতিপূরণের জন্য একটি নতুন তহবিল গঠনের প্রচেষ্টা অবশেষে আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে। ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ নামের এই তহবিল গঠনের বিষয়টি এতদিন সম্মেলনের মূল এজেন্ডাতেই রাখতে চায়নি উন্নত বিশ্বের কয়েকটি দেশ।
তবে আসরের আগে এ নিয়ে এতটাই চাপ তৈরি হয়, গতকাল এজেন্ডা ঠিক করার দিন তা সবার ভোটে পাস হয়। এজেন্ডায় প্রথমবারের মতো জায়গা করে নিয়েছে এই ক্ষতিপূরণ তহবিল। তহবিলটি মূলত ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অভিযোজন ও প্রশমনের জন্য।