রূপ আর জীববৈচিত্রের দেশ বাংলাদেশ। বিগত দিনে অনেক পরিমাণ পাখি শিকার হয়েছে আমাদের দেশে। নদী মাতৃক এ দেশে নানান প্রজাতির বাস। দেখে মেলে নানা রংঙের পাখির। পাখি শিকারের ফলে প্রতিনিয়ত আমাদের দেশের পাখির সংখ্যা কমছে। পাখি পরিবেশের এক অপরুপ সৌন্দর্য। ভালো, সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ সবারই প্রিয় কিন্তু পরিবেশ আর জীববৈচিত্র্য রক্ষা খুবই কম মানুষের কাছে প্রিয়। পাখি শিকারে নানান ধরনের উপকরণ ব্যবহার করা হয় আমাদের দেশে। বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনের মাধ্যমে পাশি শিকার কিছুটা হলেও কমেছে কিন্তু সম্পূর্ণ কমানো সম্ভব হলে পরিবেশের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে। জাতীয় সম্পদ রক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে একই সাথে তা বাস্তবায়নও করা হচ্ছে। আমরা জানি পাখিরা গাছে থাকতে পছন্দ করে আমাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে গাছ নিধন চলছে অবাধে। গ্রাম অঞ্চলে বিভিন্ন উপাশে পাখি শিকার করার ফলে পাখির সংখ্যা বিপুল হারে হ্রাস পাচ্ছে যা আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। কালেম বা কালিম পাখি এমন একটি পাখি যা বিলীন হওয়ার পথে।
কালেম বা কালিম পাখি হল জলাভূমির পাখি । তবে এরা জল-ডাঙা উভয় স্থানে বিচরণ করে। ৫০ বছর আগেও সারা বাংলাদেশের বিল-হাওরে, জলাভূমিতে বেগুনি কালিম পাখির দেখা মিলত। অবাধ শিকার, চারণ ভূমির দূষণ আর দখলে এখন এরা বেশ কোণঠাসা কয়েকটি হাওরাঞ্চলে। কালিম পাখি খুবই দুঃসাহসী, লড়াকু ও মারকুটে স্বভাবের। বেগুনি কালিম মুরগির আকারের বেগুনি, নীল-সবুজ রঙের একটি পাখি।কালিম পাখির ইংরেজি নাম Purple Swamp Hen. বাংলা অর্থ দাড়ায় বেগুনি কাদার মুরগি। বৈজ্ঞানিক নাম porphyrio porphyrio. বাংলায় এর অনেকগুলো নাম: কালিম, কায়িম, কায়েম, করমা, কালেম, সুন্দরী পাখি (হাওর অঞ্চলে), কাম পাখি,কামিয়া পাখি, বুরি পাখি ইত্যাদি। এর দৈর্ঘ্য কমবেশি ৪৫ সেমি, ডানা ২৬ সেমি, ঠোঁট ৪.৫ সেমি, পা ১৯ সেমি, লেজ ১০ সেমি ও ওজন ৬৫০ গ্রাম।
কালিম এর মাথা ফিকে, ডানা সবুজ দীপ্তিময়। লেজের অংশ কালো পালকে ঢাকা। লেজতল-ঢাকনি সাদা। এছাড়া দেহের সর্বত্র রঙ নীলচে বেগুনি। ঠোঁটের গোড়া থেকে পেছন পর্যন্ত লাল বর্ম বা মুকুট রয়েছে।
সাধারণত স্ত্রী পাখির বর্ম পুরুষ পাখির বর্ম থেকে ছোট হয়। স্ত্রী ও পুরুষ উভয়েরই চোখ রক্ত-লাল। ঠোঁট টকটকে লাল, ঠোঁটের আগা ফিকে। পা দীর্ঘ, শক্ত ও লাল। পায়ের সন্ধি বাদামি। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহ অনুজ্জ্বল; গলা ফিকে। মুখ, ঘাড়ের উপরিভাগ ও বুকে ধূসর আমেজ থাকে। ঠোঁট, পা ও পায়ের পাতা অনুজ্জ্বল লাল।
নাদুসনুদুস স্বাস্থ্যবান এই পাখিরা সব সময় যেমন সতর্ক থাকে, তেমনি যেন রেগেও থাকে। শিকারিদের বন্দুকের গুলি যদি পায়ে লাগে, তবু কাবু হয় না। পা মুখে কামড়ে ধরে উড়ে পালায়।
বেগুনি কালেমের খাদ্য তালিকার বড় অংশ জুড়ে রয়েছে জলজ উদ্ভিদ। এর প্রধান খাদ্য বীজ, শস্যদানা, কচি ঘাস, কচি পাতা, তৃণমূল, কচি জলজ উদ্ভিদ ও তার নরম কাণ্ড, শাপলাসহ পদ্মফুলের ভেতরের অংশ ইত্যাদি। এছাড়া এরা জলজ পোকামাকড় ও পোকামাকড়ের লার্ভা, মাকড়শা, কেঁচো, জোঁক, শামুক, চিংড়ি, ব্যাঙ, ব্যাঙাচি, ছোট মাছ, মাছের ডিম ইত্যাদি খায়।
জলজ সাপ, গিরগিটি, ছোট পাখি, পাখির ছানা, ডিম, মৃত দেহাবশেষ ইত্যাদি খাওয়ার কথাও জানা যায়।খাবার খাওয়ার সময় এরা লেজের নিচে সাদা অংশ প্রদর্শন করে এবং চাক চাক শব্দ করে ডাকে ।বর্ষাকালই হল কালিম পাখির প্রধান প্রজনন ঋতু। ‘জোড়’ না মিললে বা ভালো সঙ্গী না পেলে এরা ডিম পাড়ে না। মজার বিষয় হচ্ছে, স্ত্রী কালিমের মন জয় করে তবেই পুরুষ কালিমকে মিলনে যেতে হয়। আর স্ত্রী কালিমের মন জয় করার জন্য পুরুষ কালিমকে শারীরিক কসরত দেখাতে হয়।
কসরত প্রদর্শনকালে ঠোঁটে কচি ঘাস বা ডগা নিয়ে পুরুষ কালিমটি স্ত্রী কালিমের চারপাশে ঘুরে ঘুরে নৃত্য করে। নৃত্যে মুগ্ধ হলেই কেবল স্ত্রী কালিম মিলনে সম্মতি দেয়।গ্রীষ্ম-শরতে ভাসমান জলজ উদ্ভিদ-গুল্ম-কচুরিপানা ও ঝোপঝাড়ের তলায় ডাল-লতা দিয়ে বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে। একেকটি কালিম তিন থেকে সাতটি ডিম পাড়ে। ছানা ফোটে ১৮ থেকে ২৩ দিনে। ছানারা হয় শ্লেটি-কালো।
তাতে ধূসরের আভা ছড়ানো। মাথা-কপাল জোড়া শিল্ড থাকে, রং ওই লালই। পা ও পায়ের আঙুলও লাল। মা-বাবা পাখি ছানাদের নিয়ে চরাই করে। ছানাদের বড় করতে মা-বাবা পাখির যৌথ চেষ্টা থাকে।মুরগি ছানাদের মতো ছানারা মা-বাবার পিঠে চড়ে, তেমনি মায়ের দুই পাখা ও বুকের তলায় বসে অদৃশ্য হয়ে থাকে।কিশোরগঞ্জ ও শেরপুর-জামালপুরে পোষা কালিম পাখি তথা গৃহপালিত বা ফুল টেম বুরি পাখি দেখা যায়।