নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব খুলনা মহানগরের বাজার
খুলনা মহানগর নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগে সয়লাব হয়ে গেছে। নগরে এর ব্যবহার এতটাই বেড়েছে যে হাত বাড়ালেই মিলছে পলিথিন। চাল, ডাল, লবণ—যেকোনো কিছু কিনতে গেলেই তা এই নিষিদ্ধ পলিথিনে ভরে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এই পলিথিন ব্যবহারে পরিবেশদূষণের পাশাপাশি মাটির উর্বরতা শক্তিও নষ্ট হচ্ছে। জেলা ও পুলিশ প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় ব্যবসায়ীরা অবাধে এই নিষিদ্ধ পলিথিন সারা খুলনা বিভাগে সরবরাহ করছেন। এই পলিথিন জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করছে।
বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বলছে, পলিথিন ও প্লাস্টিক ভেঙে মাইক্রো প্লাস্টিকে পরিণত হচ্ছে। ওই মাইক্রো প্লাস্টিক মাটি ও পানিতে মিশে বিভিন্ন সবজি, ফল ও প্রাণীর শরীরে প্রবেশ করছে।
পরে এগুলো খাদ্য হিসেবে মানুষের শরীরের মধ্যেও প্রবেশ করছে। নিষিদ্ধ ওই পলিথিন ব্যাগের বিরুদ্ধে এখনই কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে ভবিষ্যতে খুলনার পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
পলিথিনের ভয়াবহ দিক নিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের (বিভাগ) অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন গবেষণায় খুলনার বিভিন্ন এলাকার মাটি ও পানিতে মাইক্রো প্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণী দেহেও মিলছে এর উপস্থিতি।
পলিথিনের ব্যাপক ব্যবহারের কারণেই এমনটা হচ্ছে। এই মাইক্রো প্লাস্টিক মানুষের শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এমন পরিস্থিতিতে পলিথিনের ব্যবহার ব্যাপকহারে কমিয়ে আনার আহ্বান জানান তিনি। পাশাপাশি বিকল্প হিসেবেও পরিবেশবান্ধব কিছু ব্যবহার করার পরামর্শ দেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষক।
পরিবেশ অধিদপ্তরের খুলনা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮২ সালে বাংলাদেশে পলিথিন বাজারজাত ও ব্যবহার শুরু হয়। ২০০২ সালের ১ মার্চ সরকার বাংলাদেশে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
আইন অমান্যকারীর জন্য ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকার জরিমানার বিধান রাখা হয়। বাজারজাত করলে রয়েছে ৬ মাসের জেল ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা। কিন্তু প্রশাসন অভিযান পরিচালনা করে কোনো ব্যবসায়ীকে জরিমানা বা কারাদণ্ড দিচ্ছে না। এতে বাজারে নিষিদ্ধ পলিথিন বিক্রি হচ্ছে না।
খুলনা নগরের বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, কাঁচা বাজার থেকে শুরু করে যেকোনো কিছু কিনতে গেলেই তা দেওয়া হচ্ছে ছোট-বড় পলিথিন ব্যাগে। এমনকি পাঁচ টাকার জিনিস কিনলেও তার সঙ্গে একটি পলিথিন দেওয়া হচ্ছে। আলু, তরকারি বা একটু বেশি ওজনের কিছু কিনলেই দেওয়া হচ্ছে একটু মোটা ধরনের পলিথিন ব্যাগ।
শনিবার সকালে নগরের গল্লামারী বাজারে কথা হয় মাহবুব বিল্লাহ নামের এক ক্রেতার সঙ্গে। ওই বাজার থেকে তিনি কিছু সবজি কিনে নিরালা এলাকার বাড়িতে ফিরছিলেন। তিনি জানালেন, আগে কোনো কিছু কিনতে গেলে নেটের ব্যাগ দেওয়া হতো।
বর্তমানে দোকানদারদের পলিথিন দেওয়ার প্রবণতা খুব বেড়েছে। কোনো কিছু কিনতে গেলেই দেওয়া হচ্ছে পলিথিন ব্যাগে। কোনো ঝামেলা না থাকায় সবাই ওই পলিথিন ব্যাগে করেই বাজার করে নিয়ে যাচ্ছেন। বাজার করে বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় সাত-আটটা ছোট-বড় পলিথিন হয়ে গেছে।
বিভিন্ন এলাকার দোকানদারেরা বলছেন, পলিথিন তুলনামূলক বেশ সস্তা। তা ছাড়া এর বিকল্প হিসেবে কম দামে কিছু তৈরি হয়নি। বিকল্প হিসেবে নেটের ব্যাগ ব্যবহার করা যেতে পারে কিন্তু তার মূল্য অনেক বেশি। এ কারণে মালামাল দেওয়ার জন্য তাঁরা পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করেন।
দোকানদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে যেসব দোকান থেকে তাঁরা পাইকারি হিসেবে সরাসরি পলিথিন ব্যাগ কিনতেন, সেসব দোকান এখন আর সরাসরি পলিথিন ব্যাগ বিক্রি করে না।
খুব বেশি পরিচিত বা বিশ্বস্ত না হলে ব্যাগ দেয় না। এর বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন এলাকায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা সাইকেলে ঘুরে ঘুরে পলিথিন ব্যাগের ফরমায়েশ নেন। পরে গোপনে কোনো একসময় ওই দোকানগুলোতে তা সরবরাহ করা হয়।
পলিথিন ব্যাগের ব্যবহারের নেতিবাচক দিক সম্পর্কে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) খুলনার সমন্বয়কারী মো. বাবুল হাওলাদার বলেন, পলিথিন পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। যেকোনো ধরনের পলিথিন পরিবেশে ১০০ বছরেরও বেশি টিকে থাকে।
সরকার আইন করে পলিথিনের ব্যবহার কমিয়ে আনলেও বর্তমানে প্রশাসনের উদাসীনতায় খুলনায় ব্যাপকহারে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার বেড়েছে। এতে ভবিষ্যতে পরিবেশ বিপর্যয়ের শঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) খুলনা বিভাগের সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান বলেন, বর্তমানে বাজারে খোলামেলাভাবে নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার হচ্ছে। যা খুবই উদ্বেগজনক ও হতাশার।
উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা ও কাঠোর আইন থাকার পরও নিষিদ্ধ পলিথিন বিক্রি বন্ধ করা যাচ্ছে না। ক্রেতারাও পলিথিনে মালামাল গ্রহণ করছেন। পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে সচেতনতার পাশাপাশি প্রশাসনকেও আন্তরিক হতে হবে।
খুলনা পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মো. ইকবাল হোসেন বলেন, পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বলেই সরকার আইন করে নির্দিষ্ট পুরুত্বের বাইরে সব ধরণের পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
পলিথিনের বিরুদ্ধে খুলনা পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। এর বাইরে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে বাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
পরিবেশ নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা বলছেন, নিষিদ্ধ এই পলিথিন একই সঙ্গে কৃষিজমি ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে।
এটি একটি অপচনশীল প্লাস্টিকজাতীয় পদার্থ, যা দীর্ঘদিন পর্যন্ত অপরিবর্তিত, অবিকৃত থেকে মাটি ও পানি দূষিত করে। এতে মাটির উর্বরতা শক্তি ও গুণ নষ্ট হয়ে ফলন কমে যায়। এর বাইরে পয়োনিষ্কাশনে বাধা তৈরিসহ নানাভাবে পরিবেশকে দূষিত করে।