একসময় থই থই হাওড়ে ছিল অঢেল মাছের মেলা। এখন নেই জলাধারের আগের মতো সেই টইটম্বুর অবস্থা, নেই মাছের বৈচিত্র্যময়তা। নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের হাওরের মিঠা পানিতে আর দেখা মেলে না বিভিন্ন প্রজাতির পরিচিত মাছের। জানা গেছে, ৬৪টি প্রজাতির দেশীয় মাছ প্রায় হারিয়েই যেতে বসেছে। এর মধ্যে ৩০ প্রজাতিকে সংকটাপন্ন ও ৯ প্রজাতির মাছকে চরম সংকটাপন্ন হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। সরকারিভাবে বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ সংগ্রহের জন্য কাজ করছে সংশ্লিষ্টরা।
কিন্তু এখন হাওরের পানিতে বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতির মাছসমূহকে পুণরায় অবমুক্তকরণসহ নানান প্রকল্প গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন স্থানীয় মৎস্য কর্মকর্তারা।
জানা গেছে, নেত্রকোনার ১০ উপজেলার মধ্যে মদন, মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরীর হাওরে সারা বছর পানি থাকে। এছাড়াও বাকি সাত উপজেলায় অনেকটিতে খাল-বিল ও উন্মুক্ত জলাশয় রয়েছে, যেখানে এক সময় প্রচুর পরিমাণে দেশীয় মাছ পাওয়া যেত, যা স্থানীয়দের আমিষের চাহিদা মিঠিয়ে রফতানি করা হতো রাজধানীসহ দেশের বড় বড় মাছের বাজারগুলোতে। বর্তমানে জমিতে প্রচুর পরিমাণে ইউরিয়াসহ নানা ধরনের সারের ব্যবহার ও পানি শুকিয়ে মাছ আহরণের কারণে দেশীয় অনেক মাছের দেখা আর মেলে না।
হাওরপাড়ের সাধারণ মানুষ ও জেলেদের দাবি, অধিক ফলনের আশায় জমিতে ইউরিয়া সারের ব্যবহারের কারণে এখন নদীতে মাছ পাওয়া যায় না। ফলে ভরা মৌসুমের খাল-বিল ও হাওরের পানিতে মাছ কম থাকে, এছাড়াও সংশ্লিষ্ট দফতরের সমন্বয়হীনতাকেও দায়ী করলেন তারা।
খালিয়াজুরী রসুলপুর মৎসজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি রবিন্দ্র দাস বলেন, ‘নদী, খাল, বিল, হাওর ভরাট হয়ে যাওয়া ও পানি শুকিয়ে মাছ আহরণ করায় এখন অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আগে হাওরের পানিতে পাঙ্গাস, চিতল, কাতলা, বাচা এলং দারকিনা ইত্যাদি মাছ পাওয়া যেত; যা এখন সারাদিন খুঁজেও পাওয়া যাবে না।’
বর্তমানে কিছু দেশীয় মাছের খামারি তাদের ফিসারির মাধ্যমে শিং, মাগুর, কই, টেংরা ইত্যাদি চাষ শুরু করলেও তার স্বাদ উন্মুক্ত জলাশয়ের মাছের মতো সুস্বাদু হয় না এবং হাওরের মিঠা পানির দেশীয় মাছের মতো চাহিদাও নেই এসব মাছের।
ড. রুহুল আম্বিয়া পলাশ বলেন, ‘মানুষের শরীরে যেসব প্রয়োজনীয় আমিষের চাহিদা রয়েছে, তার অধিকাংশ থাকে মাছের মধ্যে।’
নেত্রকোনার মদন উপজেলার প্রবীণ গণমাধ্যমকর্মী মোতাহার হোসেন বলেন, ‘আমরা কিশোর বয়সে যে সব মাছ হাওরের ও হাটে দেখেছি, এখন আর তা দেখা যায় না। অনেক দেশীয় মাছ হাওরের পানিতে জেলেরা খুঁজে পান না। হয়তো এখনও যা আছে, তার মধ্যে অনেক প্রজাতিও হয়তো আগামী প্রজন্মেরা খুঁজে পাবে না।’
জেলার হাওরাঞ্চলের চারদিকে পানিবেষ্টিত উপজেলা খালিয়াজুরীর বাসিন্দা স্কুল শিক্ষক শফিকুল ইসলাম শফিক বলেন, ‘অন্তত ৩০ প্রজাতির মাছ এখন আর হাওরের পাওয়া যায় না।’
নেত্রকোনা জেলা মৎস্য অফিসের সূত্র মতে, ‘কোনও বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ নেই। যদিও এই জরিপটিতে ২৫৩টি মাছ নিয়ে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। তবে ২৫৩টি প্রজাতির মধ্যে ২৫ প্রজাতির মাছকে ঝুঁকিপূর্ণ, ৩০ প্রজাতিকে সংকটাপন্ন ও ৯ প্রজাতির মাছকে চরম সংকটাপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।’
নেত্রকোনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা দীলিপকুমার সাহা জানান, বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ সংরক্ষণ করার জন্য হাওরে মাছের স্থায়ী অভয়ারণ্য করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও আরও বেশ কিছু ছোট ছোট প্রকল্প সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব আকারের পাঠানো হয়েছে, তা বাস্তবায়ন হলে এসব বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ আবারও হাওরের খুঁজে পাওয়া যাবে।