কক্সবাজারের প্রাণ-প্রকৃতি, পাহাড়-প্যারাবন রক্ষা করতে হবে
কক্সবাজারে পাহাড়-নদী-সাগর দখল করে তৈরি হচ্ছে হোটেল, রিসোর্ট, দোকানপাটসহ নানা অবকাঠামো। প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং দখল বন্ধে সমন্বয়হীনতার অভাব রয়েছে।
যে কারণে কক্সবাজার এখন বিপর্যস্ত। কক্সবাজারের প্রাণ-প্রকৃতি, পাহাড়-প্যারাবন রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এ ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
রবিবার সৈকতের একটি তারকা হোটেলে ‘বিপর্যস্ত কক্সবাজারের পরিবেশ ও প্রতিবেশ, করণীয় নির্ধারণে সেমিনার’–এ বক্তারা এসব কথা তুলে ধরেন।
অনুষ্ঠিত সেমিনারে আলোচক ছিলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সভাপতি ও মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল, নিজেরা করি সমন্বয়ক খুশী কবির, বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, এএলআরডি নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. জাহিদ ইকবাল, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কউক) সাবেক চেয়ারম্যান লে. কর্নেল (অব) ফোরকান আহমদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
পঞ্চাশের দশকের সেই কক্সবাজার এখন আর নেই উল্লেখ করে সুলতানা কামাল বলেন, ‘আমরা কক্সবাজারের যে ছবি মনে গেঁথে রেখেছিলাম, সেটি এখন নেই। অপরিকল্পিতভাবে অবকাঠামোর কারণে হারিয়ে গেছে।
কক্সবাজার এখন বিপর্যস্ত। কীভাবে বিপর্যয় থেকে কক্সবাজারকে রক্ষা করা যায়, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে। সে ক্ষেত্রে সবাইকে এক জায়গায় এসে কাজ করতে হবে। কারা কক্সবাজারকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তাদের চিহ্নিত করা না গেলে পাহাড়, নদী-খালবিল, প্যারাবন কিছুই রক্ষা করা যাবে না।’
কক্সবাজারের পরিবেশ নানাভাবে ধ্বংস হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। পাশাপাশি রামুতে বনভূমির জায়গায় ফুটবল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র করার পরিকল্পনারও সমালোচনা করেন তিনি। রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘নানাভাবে আমরা কক্সবাজারকে ধ্বংস করে ফেলেছি। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে। নলকূপে লোনাপানি আসছে। দুই হাজার অবৈধ ডাম্পারে পাহাড় কাটা হচ্ছে। খাল–নদীর বালু পাচার হচ্ছে। চার ফসলি জমিতে স্টেডিয়াম হচ্ছে।’
পরিবেশবিনাশী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের তালিকা তুলে ধরতে গিয়ে রিজওয়ানা হাসান আরও বলেন, বাঁকখালী নদীর প্যারাবন উজাড় করে ঘরবাড়ি ও অবকাঠামো হচ্ছে। সেখানে ফেলা হচ্ছে শহরের বর্জ্য-ময়লা আবর্জনা।
অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করে সেন্ট মার্টিনকে শেষ করে ফেলা হচ্ছে। শহরের ৫১ একরের পাহাড় দখল করে সরকারি কর্মচারীদের আবাসন প্রকল্প হয়। উচ্চ আদালতের রায় থাকা সত্ত্বেও এসব স্থাপনা উচ্ছেদ হয় না। জেলা প্রশাসন সেখানে বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু তাও– হচ্ছে না।
নিজেরা করির সমন্বয়ক খুশী কবিরের মতে, দখল ও পরিবেশবিনাশী কর্মকাণ্ড চলছে জবাবদিহি নেই বলে। তিনি বলেন, কক্সবাজার বিশেষ জায়গা। ষাটের দশকে যে সুন্দর কক্সবাজার দেখেছিলাম, এখন তা নেই।
চকরিয়ার সুন্দরবন এখন নেই, চিংড়ি উৎপাদনেও ধস নেমেছে। নানাভাবে সেন্ট মার্টিনকে ধ্বংস করা হচ্ছে। তামাক চাষ করে ফসলি জমি নষ্ট করা হচ্ছে। সৈকতের ওপর অপরিকল্পিতভাবে হোটেল–মোটেল হয়ে গেছে। কী করে হয়েছে, তার জবাবদিহি নেই। সমন্বয়ের বিরাট ঘাটতি রয়েছে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) জাহিদ ইকবাল বলেন, দেশের ৬৩ জেলার মানুষ আশা করে থাকে কক্সবাজারে কিছু একটা থাকতে হবে। কক্সবাজারের অনেকে পাহাড় কাটা, খাল–নদী থেকে বালু উত্তোলনে জড়িত।
বালু উত্তোলন বন্ধ করতে সম্প্রতি ১৪টি বালুমহালের ইজারা বাতিল করা হয়েছে। বাঁকখালী নদীর প্যারাবন উজাড় করে অবৈধ স্থাপনা তৈরি হচ্ছে। প্রশাসন সেসব উচ্ছেদ করলে উচ্চ আদালতে রিট করে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আসে। সঙ্গে মামলাও হচ্ছে। এরপরও প্রশাসন বসে নেই।
সভায় ‘বেঁচে থাকা কক্সবাজার’ নামে প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। তাতে উন্নয়নের নামে কক্সবাজার পাহাড়, নদী, প্রাণ–প্রকৃতি ধ্বংসের চিত্র তুলে ধরা হয়। প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে পৃথক ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করা হয়।
দুপুরে মুক্ত আলোচনায় শিক্ষক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, পর্যটন উদ্যোক্তা, রাজনীতিক, জনপ্রতিনিধি, পরিবেশ ও সামাজিক সংগঠনের অন্তত ২২ জন প্রতিনিধি মতামত তুলে ধরেন।