রাসায়নিক সারের ব্যবহারে হুমকির মুখে কৃষি পরিবেশ
মাটি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ। এটি পৃথিবীর অধিকাংশ জীবের খাদ্য উৎপাদন এবং বসবাসের মাধ্যম। ফসল উৎপাদনে মাটির উপযুক্ত বিকল্প নেই। কৃষিপ্রধান এই বাংলাদেশে প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদ খুব একটা বেশি নেই।
ফলে এ দেশের অধিকাংশ মানুষের জীবিকা কৃষি, যা সম্পূর্ণভাবে মাটির ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের ভাগ্যের সঙ্গে জড়িত সোনার চেয়ে দামি এই মৃত্তিকাসম্পদ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, এ মাটির পরিবেশ ও মাটির উর্বরতা আজ হুমকির মুখে।
এক সমীক্ষায় জানা গেছে, বাংলাদেশের ৯০ লাখ হেক্টর কৃষিজমির শতকরা ৭৫ ভাগ তার উর্বরতা হারিয়েছে। অধিক মাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহারই এর প্রধান কারণ বলে ওই সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, গত এক দশকে বাংলাদেশে আবাদযোগ্য জমির মাটির উর্বরতার মাত্রা শতকরা ২ দশমিক ৫ থেকে শতকরা ১ দশমিক ৫-এ দাঁড়িয়েছে।
এক আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর আবাদযোগ্য জমির অর্ধেকই তার উৎপাদনক্ষমতা হারিয়েছে। এর ফলে প্রতিবছর প্রায় ১ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতি হচ্ছে। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি যৌথভাবে এ সমীক্ষা চালায়।
দক্ষিণ এশীয় অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে জমির উর্বরতা হ্রাস পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক। জমিতে অধিক মাত্রায় ও নির্বিচারে রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলেই মাটির উর্বরা শক্তি ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
একই জমিতে বছরের পর বছর ধরে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে মাটির বিভিন্ন গুণগত বৈশিষ্ট্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মাটির অম্লত্ব পরিবর্তিত হয়ে পানি ধারণক্ষমতা কমে যাচ্ছে ও অণুজীবের কার্যাবলি ব্যাহত হচ্ছে। এতে মাটির উৎপাদনশীলতা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে।
ফসল উৎপাদনের সঙ্গে মাটির উর্বরতা ও উৎপাদনক্ষমতার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। মাটির উর্বরতা বলতে ফসল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদানসমূহ সরবরাহের ক্ষমতাকে বোঝায়।
অর্থাৎ মাটিকে তখনই উর্বর বলা হবে, যখন তাতে কোনো উদ্ভিদের পরিপূর্ণ বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় সব খাদ্য উপাদান সঠিক পরিমাণে বিদ্যমান থাকে। অনুর্বর মাটিতে ফসলের ফলন হয় কম, আর উর্বর মাটিতে ফলন হয় আশাব্যঞ্জক। সুতরাং অধিক উৎপাদন পেতে হলে মাটির উর্বরা শক্তি বজায় রাখতে হবে।
আদিকাল থেকেই মানুষ মাটির উর্বরা শক্তি বজায় রাখার প্রয়াস চালিয়ে আসছে। পশু পালন যুগে মানুষ লক্ষ করে দেখতে পায়, যে স্থানে পশু মল ত্যাগ করে সেখানে গাছ তর তর করে বড় হয়ে ওঠে। এভাবে মানুষ গোবর সারের ব্যবহার শেখে।
চীনা কৃষি রেকর্ডে দেখা যায়, প্রায় চার হাজার বছর আগে চীনারা কৃষিতে গাছ ও জীবজন্তুর দেহাবশেষ এবং মানুষের মলমূত্র ব্যবহার করত। আমাদের দেশেও আবহমানকাল থেকে গোবর, খৈল, ছাইয়ের ব্যবহার চলে আসছে।
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে রাসায়নিক সার এ দেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ইদানীং আমরা রাসায়নিক সারের ওপর এতই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি যে জৈব সারের কথা কেউ কেউ ভুলেই গিয়েছি। অবশ্য এখনো কিছু কিছু চাষি রাসায়নিক সারের পাশাপাশি জৈব সার ব্যবহার করছেন।
কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রেই সার অসম মাত্রায় ব্যবহার করা হচ্ছে। রাসায়নিক সারের অত্যধিক ব্যবহারে কারণে শুধু যে মাটির গুণাগুণ নষ্ট তা নয়, আমাদের পরিবেশ-প্রতিবেশও দূষিত হচ্ছে। পূর্বে শস্য কাটার পর শস্যের যে অবশিষ্টাংশ জমিতে পড়ে থাকত তা পচে জমিতে জৈব সার হিসেবে যোগ হতো।
আজকাল তাও আর জমিতে পড়ে থাকে না। কেননা ওগুলো জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আজকাল মূল্যবান গোবর সার দিয়ে ঘুটে তৈরি করে রান্নার কাজেও ব্যবহার করা হচ্ছে।
এক তথ্যে জানা যায়, দেশে প্রতিবছর প্রায় ৮০ লাখ টন গোবর সার এবং ২ দশমিক ৩২ কোটি টন বর্জ্য জ্বালানি হিসেবে উনুনে পোড়ানো হয়। এমতাবস্থায় জৈব সারের ব্যবহার ক্রমেই কমে যাচ্ছে।
জৈব পদার্থ মাটির প্রাণ। মানবদেহে রক্তের গুরুত্ব যেমন অপরিসীম, মাটিতে জৈব পদার্থের গুরুত্বই তেমনি। তাই বিভিন্ন জৈব সার যেমন গোবর, খামারজাত সার, কম্পোস্ট, বসতবাড়ির আশপাশের পচা আবর্জনা সার, খৈল, সবুজ সার, ছাই, খড়-নাড়া, কচুরিপানা, পচা পাতা ইত্যাদি ব্যবহারের মাধ্যমে মাটিকে জৈব পদার্থে সমৃদ্ধ করে উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি করা যায়। উদ্ভিদ যে কয়টি খাদ্য উপাদান গ্রহণ করে তার প্রায় সবগুলোই জৈব পদার্থে নিহিত থাকে।
সেখান থেকে ক্রমে সহজলভ্য আকারে রূপান্তরিত হয় এবং গাছ প্রয়োজন অনুসারে গ্রহণ করে থাকে। জৈব সার রাসায়নিক সারের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে এবং জৈব সার ব্যবহার করলে আনুপাতিক হারে রাসায়নিক সারের মাত্রা কমানো যায়।
মাটিতে কীটপতঙ্গ ও রাসায়নিক সারের আধিক্যজনিত কোনো বিষাক্ততা সৃষ্টি হলে জৈব সার তা কমাতে সাহায্য করে। তা ছাড়া জৈব পদার্থ মাটির অনেক ভৌত ধর্মের উন্নয়ন সাধন করে। যেমন জৈব পদার্থ বেলে মাটির পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি ও এঁটেল মাটিকে ঝুরঝুরা করে। ফলে পানি সহজেই নিষ্কাশন হতে পারে।
গাছের শিকড় বৃদ্ধি পেতে সহায়তা করে। মাটির রাসায়নিক ধর্মের উন্নয়নেও জৈব পদার্থের গুরুত্ব অপরিসীম। যেমন জৈব পদার্থ উদ্ভিদের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান ও হরমোন সরবরাহ করে এবং মাটির অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব নিয়ন্ত্রণ করে।
এ ছাড়া মাটির জৈবিক ধর্মের উন্নয়নে জৈব পদার্থের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। যেমন মাটির জীবাণুর কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি ও খাদ্য সরবরাহ করে। মাটির এসব ধর্ম অর্থাৎ ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক ধর্মের উন্নয়ন মানেই মাটির উর্বরতা সংরক্ষণ ও বৃদ্ধি সাধন।
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর সীমিত জমি থেকেই খাদ্য উৎপাদন করতে হবে। কিন্তু মাটি তার উর্বরা শক্তি হারিয়ে ফেললে খাদ্য উৎপাদনে ভাটা পড়বে এবং বর্ধিত খাদ্য উৎপাদনে দারুণ সংকট দেখা দেবে।
কাজেই এ সমস্যার গুরুত্ব উপলব্ধি করে মাটির পরিবেশ এবং তার উর্বরতা সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য রাসায়নিক সারের ব্যবহার যথাসম্ভব কমিয়ে মাটিতে জৈব সারের ব্যবহার বাড়ানোর ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। এটা করা সম্ভব না হলে বিপর্যয় অনিবার্য, সেটা হোক অদূর ভবিষ্যতে, কিংবা সুদূর ভবিষ্যতে।