বন্যপ্রাণী এখন আর বনে নিরাপদ নয়: বনমন্ত্রী
বনাঞ্চলগুলো ধীরে ধীরে মানুষের দখলে চলে যাওয়ায় বন্যপ্রাণীদের আবাসস্থল নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়কমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন।
তিনি বলছেন, ‘বন্যপ্রাণীর জন্য তাদের আবাসস্থল এখন আর নিরাপদ নয়। পাহাড়ে আদিবাসী তো ছিলই, পরে সেখানে বাস্তুচ্যুতরা গেছে, প্রাণীর আবাস মানুষের আবাস হয়েছে, তাহলে প্রাণীরা কই যাবে?’ পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে বন ভবনে এক আলোচনা সভায় একথা বলেন তিনি।
সভায় বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য নষ্টের নজির উঠে আসে আলোচনায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোস্তফা ফিরোজ টাঙ্গুয়ার হাওররের প্রসঙ্গে বলেন, ‘টাঙ্গুয়ার হাওরে যেসব পাখি আসে তারা বন্যপাখি। অথচ সেটি পর্যটন স্পট। এটা আমাদের বন বিভাগের অধীনে অভয়াশ্রম হিসেবে থাকার কথা ছিল।’
প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা মুকিত মজুমদার বাবু বলেন, ‘পূর্বাচলের মতো জায়গায় ২৪-২৫ নম্বর সেক্টরে ১৪৪ একর যে শালবন আছে রক্ষার চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও কিছু দুষ্কৃতকারী তা ধ্বংস করছে। দেশের সাফারি পার্কের আশপাশের জায়গায় আজকাল ইন্ডাস্ট্রি হচ্ছে।’
মুকিত মজুমদার সাফারি পার্কগুলোকে কেন্দ্র করে এর আশপাশের দুই কিলোমিটার এলাকা সংরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণা করার আহ্বান জানান।
বিষয়ভিত্তিক উপস্থাপনায় ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটির কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টিটিভ মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ৩১ টি বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এক-চতুর্থাংশ বিলুপ্তির কারণ শিকার ও বাণিজ্য। আমাদের রিপোর্টে এসেছে বাণিজ্যের সবচেয়ে উপরে আছে টিয়া, কাকাতুয়ার মতো পাখি, দুই নম্বরে আছে কাছি কচ্ছপের মতো সরীসৃপ। ২৩০০ মেট্রিক টন হাঙরের পাখনা বাংলাদেশ থেকে হংকংয়ে ইমপোর্ট হয়েছে। এতেই বোঝা যায় কত হাঙর হত্যা করা হচ্ছে।
এই বিষয়গুলো সরকার আমলে নেবে জানিয়ে মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন বলেন, ‘টাঙ্গুয়ার হাওরকে কীভাবে বন্যপ্রাণী অভয়াশ্রম করা যায় তা নিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সাথে আলোচনা করব। বঙ্গবন্ধুর নামে যে সাফারি পার্ক তার আশপাশে যেন ইন্ডাস্ট্রি গড়ে না ওঠে তার জন্য ডিসির সাথেও কথা বলব।’
বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে সরকারের উদ্যোগ তুলে ধরে তিনি বলেন, বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট নিয়মিত কাজ করা যাচ্ছে। সুন্দরবনে ড্রোন ব্যবহার করে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে৷ ক্যামেরা ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাঘ জরিপ করা হচ্ছে। বিপন্ন বন্যপ্রাণী রক্ষায় ‘রেড লিস্ট’ করা হয়েছে।
তার ভাষ্যে, পরিবেশ-প্রতিবেশ ঠিক রেখে বন্যপ্রাণীর আবাস এবং সেখানে প্রাণীর অবাধ বিচরণ নিশ্চিত করা না গেলে বন ও বন্যপ্রাণীর সুরক্ষা করা সম্ভব হবে না।
অনুষ্ঠানে উপ-প্রধান বন সংরক্ষক মো. জাহিদুল কবির বন্যপ্রাণী ও অভয়াশ্রম রক্ষায় বন বিভাগের নানা উদ্যোগ, অর্জন ও সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, ‘৪ হাজার ৫৭৮ বর্গকিলোমিটার বন আমরা সংরক্ষণের আওতায় আনতে পেরেছি। এর বাইরে অনেক জায়গা আমরা, ফিশারিজ বিভাগ সংরক্ষণ করলেও যথাযথ ম্যাপিং না হওয়ায় আন্তর্জাতিকভাবে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে দেখাতে পারছি না।’
অনুষ্ঠানে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার বলেন, ‘এই আলোচনায় যারা আছেন তারা কালেভদ্রেও একটা বন্যপ্রাণী দেখেন না৷ বনসংশ্লিষ্ট এলাকায় যাদের সাথে বন্যপ্রাণীর নিয়মিত দেখা হয়, তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে এবং জীববৈচিত্র্যের আধার যেখানে আছে, সেখানে এসব কার্যক্রম চালাতে হবে। গাছ লাগাচ্ছি সব বড় গাছ, সেটা বিক্রি করা যায় বলে। কিন্তু ছোট গাছ রাখছি না। তাহলে ছোট পাখি কোথায় যাবে? কী খাবে? তাই তারা তো থাকছে না আর, খাবার-বাসস্থান না পেয়ে চলে যাচ্ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমি শুনেছি, ভারতে একটা চিড়িয়াখানা আছে, যার শতভাগ প্রাণী বাংলাদেশ থেকে নেওয়া। কেউ না কেউ সেটা করেছে। সব ডিপার্টমেন্টের লোকই এর সঙ্গে আছে। তারা যদি সচেতন না হন, তাহলে এখানে বৈঠক করে আমরা কিছু করতে পারব না।’
প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী জানান, বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলের কাছাকাছি যে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী আছে, তাদের সঙ্গে আলোচনা চলছে।
বন্যপ্রাণী যেমন হরিণের মাংস খাওয়ার ‘লালসা’ দূর করতে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি, গাছ বাঁশঝাড় কাটার আগে পাখিগুলো কোথায় যাবে, এই চিন্তা মানুষের ভেতরে তৈরি করার তাগিদ দেন তিনি।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ফারহিনা আহমেদও অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।