জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বর্ষাকাল চললেও বৃষ্টির দেখা নেই
ঋতুচক্রে বর্ষাকাল চললেও বৃষ্টির দেখা নেই। মাঝেমধ্যে দু-চার ফোঁটা বৃষ্টি হলেও যশোর অঞ্চলে শ্রাবণের সেই মুষলধারার বৃষ্টি নেই। বরং প্রচণ্ড গরমে জনজীবনে নাভিশ্বাস।
বর্ষাঋতুর এ খরায় কৃষকের ফসলের মাঠও ফেটে চৌচির। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর এসময়ের তুলনায় এ বছর বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এক-চতুর্থাংশেরও কম। বৃষ্টির পরিবর্তে বরং আষাঢ়-শ্রাবণে প্রকৃতিতে ঝরছে প্রখর খরতাপ। এতে জনজীবন বিপর্যস্ত হওয়ার পাশাপাশি আমন চাষিরাও রয়েছেন বিপাকে।
আষাঢ় মাস বিদায় নিয়ে শ্রাবণ শুরু হলেও যশোরে কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টির দেখা মেলেনি। গত ১ জুন থেকে ১৫ জুলাই পর্যন্ত দেড় মাসে যশোরে মোট ১০৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
অথচ গত বছর একই সময়ের ১৫ দিনে ৪৫৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এবার বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এক-চতুর্থাংশেরও কম।
তথ্য বলছে, গত বছর জুনে যশোরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৩৬০ মিলিমিটার। এ বছর জুনে বৃষ্টিপাত হয়েছে মাত্র ৬৪ মিলিমিটার। গত বছর জুলাইয়ে বৃষ্টিপাত হয়েছিল ৩৩৯ মিলিমিটার।
তবে এর মধ্যে প্রথম পনের দিনে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় ৯৩ মিলিমিটার। এ বছর জুলাইয়ের ১৫ দিনে বৃষ্টিপাত হয়েছে ৪৪ মিলিমিটার।
বৃষ্টিহীন এ দিনগুলোতে প্রতিদিনই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে। শুক্রবার (১৫ জুলাই) যশোরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
বৃহস্পতিবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৪ দশমিক ৮ ডিগ্রি এবং বুধবার রেকর্ড করা হয় সর্বোচ্চ ৩৫ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা।
একদিকে বৃষ্টি নেই, অন্যদিকে গরমে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। গ্রীষ্মের গরমে তাপমাত্রার ব্যরোমিটারের পারদ ৪০ ডিগ্রির আশেপাশে ঘুরছে। কিন্তু তখন বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ তুলনামূলক কম থাকে।
এখন তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রির আশেপাশে থাকলেও আর্দ্রতা বেশি থাকায় গরমও বেশি অনুভূত হচ্ছে। রবিবার সন্ধ্যা ৬টায় বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ ছিল ৭৭ শতাংশ; দুপুর ১২টায় ছিল ৬০ শতাংশ। গ্রীষ্মে দিনে এ আদ্রতার পরিমাণ অধিকাংশ সময় ৫০ শতাংশের নিচে থাকে।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অনুষদের ডিন পরিবেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. সাইবুর রহমান মোল্যার বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণেই পরিবেশ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে।
যেখানে শীত নেই, সেখানে শীত পড়ছে, যেখানে গরম নেই, গরম পড়ছে। বর্ষাকালে বৃষ্টি হচ্ছে না, শীতকালে শীত পড়ছে না। আবার গরমকালে মাত্রাতিরিক্ত গরম।
ড. সাইবুর রহমান মনে করেন, মূলত মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের কারণে ওজন স্তরের ঘনত্ব কমছে। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি ওজন স্তরে আটকে যেতো।
এখন এ রশ্মি ওজন স্তর ভেদ করে পৃথিবীতে চলে আসছে। ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধিসহ পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে। মূলত পরিবেশের এ পরিস্থিতি ‘গ্লোবাল ক্লাইমেট চেঞ্জের ইমপ্যাক্ট’। আর আমরা এর শিকার।
‘বৈশ্বিকভাবে সিএফসি গ্যাস, কার্বন নিঃসরণ কমানোর পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব’- বলেন এ পরিবেশবিদ।
এদিকে গরমের কারণে শ্রমজীবী মানুষেরা বিপাকে পড়ছেন। শহরের রেলস্টেশন এলাকার ভ্যান চালক লোকমান মিয়া জানালেন, গরমে মালামাল আনা নেয়ায় খুব কষ্ট হচ্ছে। অল্পতেই ঘেমে যাচ্ছি। শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। আষাঢ় শ্রাবণে এতো গরম পড়তে দেখিনি।
বিপাকে পড়েছেন আমন চাষিরাও। বৃষ্টিপাত না থাকায় আমন আবাদ নিয়েও তাদের মধ্যে সংশয় দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ সেচ দিয়েই বীজতলা তৈরি করেছেন।
চাঁচড়া এলাকার কৃষক শামীম হোসেন জানালেন, বোরো আবাদে লাভ হয়নি। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সেচ দিয়েই আমনের বীজতলা তৈরি করেছেন। চারা রোপনের সময় এগিয়ে আসলেও বৃষ্টি না হওয়ায় ক্ষেত প্রস্তুত করতে পারছেন না। সেচ দিয়ে আমন চাষ করতে গেলে লোকসানের বোঝা আরও বাড়বে।