শিল্পায়ন ও নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে প্লাস্টিকের (পলিথিনসহ) ব্যবহার বাড়ছে। মানুষের আয় বাড়ার সঙ্গে বর্ধিত পরিমাণে প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারের সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশেও প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়ছে। ২০১৪ সালের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বছরে গড়ে মাথাপ্রতি প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহৃত হয় ৩ দশমিক ৫ কিলোগ্রাম। ইউরোপের গড় মাথাপ্রতি বছরে ১৩৬ কিলোগ্রাম এবং উত্তর আমেরিকায় ১৩৯ কিলোগ্রাম।
অনেকেই বাসাবাড়িতে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য রাখার ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের পণ্য ব্যবহার করে থাকেন। অপেক্ষাকৃত সস্তা ও সহজলভ্য হওয়ায় প্রতিদিন আমরা নানাভাবে প্লাস্টিকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছি।
বিশেষ করে ওয়ান-টাইম ইউজ প্লাস্টিক (বোতল, কাপ, প্লেট, বক্স, চামচ, স্ট্র) দ্রব্যের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। মাছ-মাংস, শাক-সবজি, ডাল, চিনি, রসগোল্লা ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্য শোভা পাচ্ছে প্লাস্টিকের মোড়কে।আকার ও ওজনে সুবিধাজনক হলেও প্লাস্টিকের বোতল স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্লাস্টিকের পাত্রে কিছু রেখে খাওয়া এবং প্লাস্টিকের বোতলে পানি পান করা ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। প্লাস্টিকের বোতলে থাকা রাসায়নিক পদার্থ খাবারের মধ্যে চলে যায়।এটি খাবার থেকে শরীরের ভেতরে প্রবেশ করে। শুধু তাই নয়, প্লাস্টিকের পাত্রে খাবার গরম করলে ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান বের হয়ে খাবারের মধ্যে প্রবেশ করে। এর ফলে ক্রমাগত বাড়ছে ক্যান্সার, অ্যাজমা, অটিজম, হরমোনজনিত সমস্যা, গর্ভপাতসহ নানা জটিল রোগ।
ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য
বিশ্বের সাগর-মহাসাগরে প্রতিবছর প্রায় আশি লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য জমছে। সমুদ্রের স্রোত প্লাস্টিক বর্জ্য ভাসিয়ে নিয়ে যায় দূরদূরান্তে। ২০১৮ সালে প্রকাশিত জাপানিজ গবেষণা রিপোর্ট জানিয়েছে যে ফিলিপাইনের অদূরে প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরতম মারিয়ানা ট্রেঞ্চে প্লাস্টিকের ব্যাগের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
অপর এক গবেষণা তথ্য অনুযায়ী, প্লাস্টিক বর্জ্যের ক্ষুদ্রতম ভগ্নাংশ বা ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’ বায়ুতাড়িত হয়ে পর্বতচূড়ায় মিলছে। বায়ুদূষণের অন্যতম ক্ষতিকর উপাদান যে ভাসমান বস্তুকণা, ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’ সে তালিকায় যোগ হচ্ছে বিশ্বজুড়ে।
বাতাসের মাধ্যমে মানুষের শরীরেও মাইক্রোপ্লাস্টিক ঢুকে পড়ছে। ফলে প্লাস্টিকের দূষণ কেবল ঘুরপথে নয়, সরাসরি মানুষের শরীরে প্রবেশ করে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। সমুদ্র-মহাসমুদ্রে প্লাস্টিক বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ায় পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, মাছ ও সামুদ্রিক প্রাণীর জীবন মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে। কেবল ক্ষুদ্র সামুদ্রিক প্রাণী নয়, বিশাল তিমি মাছও প্লাস্টিক দূষণে মারা পড়ছে। সামুদ্রিক প্রাণী ও মাছের শরীরে ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’ সঞ্চিত হয়ে তা খাদ্যচক্রের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে।
এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, প্রতিবছর প্রায় দশ লাখ পাখি প্লাস্টিক দূষণের শিকার হচ্ছে। এখনই এসকল পরিযায়ী পাখির প্রায় ৯০% এর পাকস্থলিতেই পাওয়া যাচ্ছে প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্য। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা দাঁড়াবে ৯৯% এ, যা এসব পাখির অস্তিত্বের পথে বিরাট বড় ধরণের এক বাঁধা বা হুমকি। এ পাখিরা বাঁচার জন্য সামুদ্রিক প্রাণিদের খেয়ে থাকে।অন্যদিকে যেহেতু সমুদ্রে প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ অত্যাধিক হারে বেড়েই চলেছে, তাই সেসব সামুদ্রিক প্রাণি গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে সেসব পাখির পাকস্থলিতেও চলে যাচ্ছে প্লাস্টিক পদার্থগুলো।