জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক কপ২৫ (COP25) সম্মেলন এবং গ্রিণহাউজ গ্যাস নির্গমণ হ্রাসে বিশ্ব চ্যালেঞ্জিং
জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক কপ ২৫ (COP25) সম্মেলন এবং গ্রিণহাউজ গ্যাস নির্গমণ হ্রাসে বিশ্ব চ্যালেঞ্জিং
গত ০২/১২/২০১৯ খ্রি: হতে স্পেনের মাদ্রিদে জাতিসংঘের জলবায়ু বিষযক সম্মেলন কপ২৫ সম্মেলন শুরু হয়েছে। সম্মেলনটি আগামী ১৩/১২/২০১৯ খ্রি: পর্যন্ত চলবে এবং চিলির পরিবেশ মন্ত্রী ক্যারোলিনা শ্মিট এ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করছেন। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ওয়াজেদসহ বিশ্বের রাষ্ট্র / সরকার প্রধানগন এ গুরুত্বপুর্ণ সম্মেলনে যোগদান করছেন।
এ সভায় প্যারিস জলবায়ু পরিবর্তন চুক্তির বাস্তবায়ন অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হবে। কপ২৫ সম্মেলনের উদ্দেশ্যে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ১৭৫০ সালের শিল্প বিপ্লবের পূর্বাবস্থা হতে ২° সে: এর মধ্যে এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ১.৫° সে: মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার প্রচেষ্ঠা চালিয়ে যাওয়া।
জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত একটি আন্তর্জাতিক প্যানেলের রিপোর্ট অনুযায়ী বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫° সে: এ সীমাবদ্ধ রাখা বাস্তবিক ভাবে সম্ভব, কিন্তু এর জন্য মানুষের জীবন যাত্রার এবং শক্তি উৎপাদন ও পরিবহন ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন আনতে হবে। এ সম্মেলনেকে সামনে রেখে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (WMO) বৈশ্বিক জলবায়ুর অবস্থা নিয়ে একটি খসড়া বিবৃতি দিয়েছিল এবং দীর্ঘদিন হতে বৈশ্বিক উষ্ণনতা বৃদ্ধির যে ধারা তা অব্যহত থাকার বিষয়টি অবগত করা হয়েছে।
ভূ-পৃষ্ঠের উষ্ণতাবৃদ্ধির জন্য দায়ী গ্রিনহাউস গ্যাস (প্রধানত: কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড) এর পরিমান যে বায়ুমন্ডলে ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাও WMO কর্তৃক বিশ্ববাসীকে জানানো হয়েছে। গ্রিণহাউস গ্যাস নির্গমণ এর সাথে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো (Stakeholders) কে অর্থাৎ গ্রিণহাইজ গ্যাস বায়ুমন্ডলে নির্গমণকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানসমূহকে যেমন জীবাস্মা জ্বালানী প্রজ্যলনের মাধ্যমে শিল্প, বিদ্যুৎ, যন্ত্রচালিত মোটরগাড়ী ও নৌযান ইত্যাদি উৎপাদনকারী, সরবরাহকারী ও ব্যবহারকারী কর্তৃপক্ষসমূহকে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমণ বন্ধে জোর প্রদক্ষেপ গ্রহন করতে সরকারসমূহকে নীতি প্রণয়ন ও বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে হবে।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (WMO) এর তথ্যমতে চলতি বছর বায়ুমন্ডেলে গ্রিন হাউস গ্যাস সমুহের নির্গমণের পরিমাণ আরও একটি নতুন রেকর্ড স্থাপন করেছে। বায়ুমন্ডলে এভাবে গ্রীন হাউস গ্যাসের নির্গমণ এর বৃদ্ধির অর্থ হলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মমের ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিরুপ পরিবেশের যেমন ঘূর্নিঝড় জ্বলোচ্ছাস, বন্যা-খরা, ভূমিধস, সমুদ্রের পানিরস্তর বৃদ্ধির মত জলবায়ু পরিবর্তনের চরম প্রভাব মোকাবেলা করতে হবে।
WMO এর সম্প্রতি প্রকাশিত গ্রিণহাউস গ্যাস বুলেটিনে দেখিয়েছে যে, বায়ুমন্ডলে CO2 এর পরিমান ২০১৭ হতে ২০১৮ পর্যন্ত বায়ুমন্ডলে বৃদ্ধি পেয়ে ৪০৭.৮ পিপিএম (Parts Per million) এ দাড়িয়েছে, যেখানে ২০১৭ সালে ছিল ৪০৫.৫ পিপিএম। ২০১৭ হতে ২০১৮ পর্যন্ত বায়মন্ডেলে CO2 এর বৃদ্ধি ২০১৬ হতে ২০১৭ পর্যন্ত বৃদ্ধির কাছাকাছি এবং বিগত দশকের তুলনায় গড়বৃদ্ধির অধিক। CO2 শতাব্দি পর শতাব্দি ধরে বায়ুমন্ডল ও মহাসাগরে অবিকৃত অবস্থায় থাকে, বিনাশ হয়না। গ্লোবাল অ্যাটমেস্ফিয়ার ওয়াচ নের্টওয়ার্ক (GAWN) এর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী গত দশকের তুলনায় বায়ুমন্ডেলে মিথেন (CH4) ও নাইট্রস অর্ক্সাইড (N2O) এর ঘনত্ব অনেক বেড়েছে।
১৯৯০ সাল থেকে বায়ুমন্ডলে গ্রিণহাউজ গ্যাসের দীর্ঘ কাল ধরে ক্রমবর্ধমান ভাবে বৃদ্ধির ফলে ভূ-পৃষ্ঠে উষ্ণতায়নের ধারক রেডিয়েটিভ বল (Force) এর ৪৩% বৃদ্ধি ঘটেছে। মার্কিন জাতিয় মাহসাগর ও বায়ুমন্ডলের প্রশাসন (US National Oceanic and Atmospheric Administration) এর তথ্য মতে এ বৃদ্ধির ৮০% এরই ভুমিকা রয়েছে বায়ুমন্ডলে CO2 এর বৃদ্ধির কারনে।
WMO এর সেক্রেটারী জেনারেল পেত্তেরি তালাস বলেছেন যে, প্যারিস চুক্তির অধিনে এতোসব প্রতিশ্রুতি সত্তেও বায়ুমন্ডেলে গ্রিণহাউস গ্যাসের ঘনত্বের কোন কমতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, বরং বেড়েই চলছে। তিনি আরও বলেছেন যে, আমাদের প্রতিশ্রুতি দাতাদের প্রতিশ্রুতিকে কাজ করে দেখাতে হবে এবং মানবজাতির ভবিষ্যতের কল্যাণে আরও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে।
WMO এর বুলিটিনে উল্লেখিত গ্রিণহাউজ গ্যাস ণির্গমণের বৃদ্ধির চিত্র নিন্মে বর্ণনা করা হ’ল:-
কার্বনডাই অক্রাইড (CO2)
মানব ক্রিয়াকলাপ যেমন তেল, গ্যাস, কয়লা জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করে শিল্প উৎপাদন, বিদ্যুৎ উৎপাদন, গাড়ী- নৌযান ব্যবহারের ফলে, বাড়ী ঘর নির্মণের জন্য ইট পোঁড়ানো, খাদ্য উৎপাদন, রান্না-বান্না ও কৃষি কাজে ফসলের উচ্ছিষ্ট অংশের প্রজ্যলন ও পচন, পশুপালন, উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহাবশেষের পচন, যোগাযোগ ও পরিবহন সকল কাজেই CO2 উৎপাদন/ নির্গত হয়।
২০১৭ সালে বায়ুমন্ডলে এর ঘনত্ব ছিল ৪০৫.৫ পিপিএম (Parts Per million), যা ২০১৮ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাড়ায় ৪০৭.৮ পিপিএম এ, যা ১৭৫০ সালের শিল্প বিপ্লবের পূর্বের ২৮০.০০ পিপিএম অপেক্ষা ১৪৭.৮০ পিপিএম বা ১৪৪.৬৪৫% আধিক।
২০১৭ হতে ২০১৮ সালে বায়ুমন্ডলে CO2 এর বৃদ্ধির হার গত দশকের বাৎসরিক গড় বৃদ্ধির হার অপেক্ষা অধিক ছিল। এল ন্যানো (বিষুব রেখা বরাবর প্রশান্ত মাহাসাগরের উষ্ণতায়নের কারনে দক্ষিণ আমেরিকার উপকুলে সৃষ্ট একটি অস্বাভাকি আবহাওয়াকালীন সময়) চলাকালীন বায়ুমন্ডল পর্যবেক্ষণে পরপর তিন দশক ধরে CO2 এর বৃদ্ধির হার নিন্মরূপ:-
১৯৮৫-১৯৯৫ সাল পর্যন্ত প্রতিবছরে বৃদ্ধি ১.৪২ পিপিএম
১৯৯৫-২০০৫ সাল পর্যন্ত প্রতিবছরে বৃদ্ধি ১.৮৬ পিপিএম
২০০৫-২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রতিবছরে বৃদ্ধি ২.০৬ পিপিএম
মিথেন (CH4)
মিথেন হল বায়ুমন্ডলে র্দীঘ দিন ধরে অবিকৃত থাকা ২য় গ্রীন হাউস গ্যাস যা রেডিয়েটিভ বল ( বায়ুমন্ডল উষ্ণতায়নের) ১৭% এর জন্য দায়ী। প্রাকৃতিক উৎস যেমন জলাভূমি ও পোঁকামাকড়ের ক্রিয়া কলাপ হতে এবং ৬০% মানুষের ক্রিয়া কলাপের ফলে যেমন পশু-পাখি পালন, কৃষি কাজ, জীবাস্মা জ্বালানী ( প্রেট্রোলিয়াম পদার্থ, কয়লা ও প্রাকৃতিক গ্যাস) এর ব্যবহার, ভূমি ভরাট ও কর্তন-উলট-পালট করণ, উদ্ভিদ ও জীবের দেহের পচন বা পোড়ানোর ফলে সৃষ্টি হয়।
২০১৮ সালে বায়মন্ডলে মিথেন গ্যাসের পরিমান বৃদ্ধি পেয়ে ১.৮৬৯ পিপিএম এ দাড়িয়েছে, যা ১৭৫০ সালের শিল্প বিপ্লব এর পূর্ব অবস্থার ০.৭০০ পিপিএম অপেক্ষা ১.১৬৯ পিপিএম বা ২৬৭% বৃদ্ধি ঘটেছে। ২০১৭ হতে ২০১৮ পর্যন্ত CH4 এর ঘনত্ব বৃদ্ধি ২০১৬ হতে ২০১৭ এর বৃদ্ধি অপেক্ষা বেশী এবং গত একদশকের গড় বৃদ্ধির হার অপেক্ষাও বেশী ।
নাইট্রাস অক্সাইড (N2O)
N2O বায়ুমন্ডলের ০৬% উষ্ণতায়নের জন্য দায়ী। বায়ুমন্ডেলে ৬০% N2O এর নির্গমণ হয় প্রাকৃৃতিক উৎস যেমন সমুদ্রের ডেউয়ের কারণে ও মাটি হতে নির্গমণে এবং ৪০% নির্গমণ ঘটে মানুষের কার্যক্রিয়া যেমন উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহের পচন ও পোড়ানের কারনে, কৃষিতে রাসায়নিক সার ব্যবহারে এবং জীবাস্মা জ্বালানী প্রজ্যলনের ফলে।
২০১৮ সালে বায়ুমন্ডেলে N2O এর ঘনত্ব ছিল ০.৩৩১১ পিপিএম, যা ১৭৫০ সালের শিল্পে বিপ্লবের পূর্বের ০.২৭০ পিপিএম হতে ০.০৬১১ পিপিএম বা ১২৩% অধিক । ২০১৭ হতে ২০১৮ সাল পর্যন্ত N2O এর বৃদ্ধি ২০১৬-১৭ সালের বৃদ্ধি অপেক্ষা অধিক এবং এ বৃদ্ধি গত একদশকের বৃদ্ধির হার অপেক্ষাও অধিক।
N2O স্ট্র্যাটোস্ফেরিক ওজোন স্থর (Stratospheric Ozone Layer) ধ্বংস করতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে, যার ফলে সূর্যের ক্ষতিকারক অতিবেগুনী রশ্মি (Ultraviolet rays) সরাসরি বায়ুমন্ডল ভেদ করে ভূ-পৃষ্ঠে পোঁছে। Ultraviolet রশ্মির ফলে মানুষের ত্বক ক্যানসারসহ নানা রকম জটিল রোগ হয় এবং উদ্ভিদ এরও নানাবিধ ক্ষতি করে।
Source: World Meteorological Organization Bulletin, Published on 25 November 2019, Press Release Number: 25112019, Geneva.