বিষয়: বঙ্গবন্ধুর পরিবেশ ও জলবায়ু উন্নয়ন ভাবনা
“এ প্রতিযোগিতায়: স্পনসর চাই”
সুচনাঃ সপ্তদশ শতকে শিল্প বিপ্লবের পর হতে বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত মানুষের ধারণা ছিল যে, শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেই পৃথিবীর জন্য মঙ্গলজনক হবে। তাই মানুষ পরিবেশ ধবংস করে শিল্প কারখানা স্থাপন ও প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ শুরু করে।
বিশ শতকের মাঝামাঝি এসে মানুষ বুঝতে পারে যে প্রাকৃতিক সম্পদ কমে আসছে। পরিবেশ নষ্ট হওয়ার ফলে মানুষের অসুখ-বিসুখ বেড়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন প্রকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে অর্থনৈতিক উন্নতি পিছেয়ে পড়ছে। মানুষ বুঝতে পারলো যে শুধু অর্থনৈতিক উন্নতি নয়, মানুষের মঙ্গলের জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশ সুন্দর রাখা জরুরি।
তখন থেকেই মানুষ শুরু করলো উন্নয়নের পাশাপাশি পরিবেশ ভালো রাখার প্রচেষ্টা। ১৯৭০ সালের ২২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমবারের মতো পরিবেশ সুরক্ষায় ‘আর্থ ডে’ বা ‘পৃথিবী দিবস’ উদযাপিত হয়। কিন্তু বাঙ্গালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আরও অনেক আগে থেকেই প্রাকৃতিক পরিবেশের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন।
তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, তিনি পাহাড়, সমুদ্র ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত জায়গায় ভ্রমণ করতে ভালোবাসতেন, গাছ লাগাতে ভালোবাসতেন এবং পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ভালোবাসতেন। সুতরাং বঙ্গবন্ধু পরিবেশ সুরক্ষায় সবসময় সচেষ্ট ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর পরিবেশ উন্নয়ন ভাবনাঃ যে সময় পরিবেশ রক্ষায় ‘আর্থ ডে’ পালিত হয় যে সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙ্গালী জাতিকে পরাধীনতার হাত হতে মুক্ত করতে সংগ্রাম করছেন। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনার পর পরই তিনি দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করেন।
জাতির পিতা মনে করতেন, এ দেশের মূল সম্পদ হলো উর্বর ভূমি, সবুজ প্রকৃতি এবং প্রাণবৈচিত্র্য। ‘গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান’ এই শ্লোগানের বহু আগেই তিনি বৃক্ষরোপন অভিযান শুরু করেন।
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু গণভবন, বঙ্গভবন ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে গাছ লাগান। এ বছরেই তিনি মহাসড়কের পাশে গাছ লাগানোর কর্মসূচি শুরু করলেন। দেশের মানুষকে নিজ নিজ জমি, ঘর-বাড়ির আশেপাশে এবং পতিত জমিতে গাছ লাগানোর জন্য আহবান জানান।
তিনি ঢাকা শহরের প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় ১৯৭২ সালে রেসকোর্স ময়দানে ঘোড়দৌড় বন্ধ করেন এবং প্রচুর গাছ লাগিয়ে সুদৃশ্য বাগান তৈরি করেন। তিনি বাগানটির নাম দেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। জাতির পিতা ভবিষ্যতে পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন রোধের গুরুত্ব উপলব্ধি করে তা স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করেন।
সংবিধানের ১৮ক নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করবে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করবে।” দেশের বন্যপ্রাণীর গুরুত্ব উপলব্ধি করে এদের সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য বঙ্গবন্ধু বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করেন।
এর মাধ্যমে তিনি দেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। এছাড়া, ১৯৭৫ সালে তিনি ন্যাশনাল হার্বেরিয়াম (চাপযুক্ত, শুকনো উদ্ভিদের নমুনা সংরক্ষণাগার যা কাগজে লাগানো হয়। কোন অঞ্চলের উদ্ভিদের বিদ্যমান ও বিলুপ্ত প্রজাতির আকার, পাতা, ফুল ও ফলের রং সহ একত্রে সংরক্ষণ করা হয়। উদ্ভিদ বিজ্ঞানের গবেষণা ও স্টাডিতে এক জাগায় একত্রে সংরক্ষিত এ ধরণের সংরক্ষণাগারের গুরুত্ব অপরিসীম) প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার কারণেই তিনি ‘বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন’-কে জাতীয়করণ ও আধুনিকায়ন করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভাবনাঃ বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন যে, শুধুমাত্র ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় গাছ লাগিয়ে পরিবেশ সংরক্ষণ করা সম্ভব না। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষার জন্য দরকার প্রাকৃতিক বন।
তিনি লক্ষ্য করেন যে, দেশে নদ-নদী বেশি থাকায় এবং সমুদ্র তীরবর্তী স্থানে অবস্থিত হওয়ায় বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। ভবিষ্যতে এ ধরণের দুর্যোগের মাত্রা ও ঘনত্ব বৃদ্ধি পেতে পারে। ফলে ক্ষতির পরিমানও বৃদ্ধির আশংকা থাকবে।
সুতরাং এ কারণে বঙ্গবন্ধু জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। বিশেষভাবে তিনি লক্ষ্য করেন যে, সমুদ্রের পাড়ে বসাবাসকারী লোকজন সব থেকে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে। ফলে তাঁর পরিকল্পনায় সমুদ্র উপকূল বিশেষ গুরুত্ব পায়।
তাই এ সব ক্ষতির হাত হতে দেশকে রক্ষা করার জন্য তিনি উপকূলীয় বনায়নের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনিই প্রথম উপকূল এলাকায় বনায়ন শুরু করেন যা একাবিংশ শতাব্দীতে এসেও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করছে।
এছাড়াও, বঙ্গবন্ধুই প্রথম হাওড়-বাওড়, নদ-নদী ও অন্যান্য জলাভূমি উন্নয়নের রূপরেখা প্রণয়ন করেন যা পরবর্তীতে জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। এমন গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের প্রস্তুতির সময় ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে ভোলা জেলায় শক্তিশালী ঘুর্ণিঝড় আঘাত হানে। সে সময় ৩,৫০,০০০ জন মানুষের মৃত্যু হয়।
হাজার হাজার ঘর-বাড়ি ধ্বংস হয় এবং ২০,০০০ মাছ ধরা নৌকা ভেসে যায়। এছাড়া, হাজার হাজার গবাদি পশু, হাঁস-মুরগী মরে যায়। নষ্ট হয় ফসলি জমি, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা। দুঃখী মানুষের আশার প্রতীক জাতির পিতা নির্বাচনী প্রচারণা বন্ধ করে আক্রান্ত মানুষের জন্য ত্রান সংগ্রহ করে ভোলায় চলে যান এবং তাদের পাশে দাঁড়ান।
পরবর্তীতে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদে ঘুর্ণিঝড় মোকাবেলায় “সাইক্লোন প্রিপেয়ার্ডনেস্ প্রোগ্রাম (সিপিপি)” বা ‘ঘুর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি’ প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু সিপিপি এর ২০,৪৩০ জন স্বেচ্ছা সেবককে সম্মানিত করার মাধ্যমে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। সিপিপি-কে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে শক্তিশালী করতে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে এবং একটি ওয়্যারলেস কেন্দ্র স্থাপন করে।
এছাড়াও, স্বেচ্ছাসেবকদের মাঝে ১৯৭০টি রেডিও, ২০০০টি মেগাফোনসহ ইলেক্ট্রিক সাইরেন, ২০০০টি টর্চ লাইট, ১৫০০টি প্রাথমিক চিকিৎসা বক্স, ৫০০টি ওয়াকিটকি বিতরণ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে সুইডিস রেডক্রসের আর্থিক এবং স্থানীয় রেডক্রসের সার্বিক সহায়তায় কক্সবাজারে একটি রাডার কেন্দ্র স্থাপন করা হয়।
পরবর্তীতে এগুলো দুর্যোগের আগাম তথ্য প্রচারসহ দুর্যোগ মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের আর্থিক সহায়তায় শতাধিক বহুতল আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করেন। এছাড়া, গবাদি পশু, হাঁস-মুরগী ইত্যাদির জন্য ১৩৭টি মাটির কিল্লা নির্মাণ করেন যা মুজিব কিল্লা নামে পরিচিত।
এসব আশ্রয়কেন্দ্র ও কিল্লা বর্তমান সময়েও ঘুর্ণিঝড় মোকাবেলায় কার্যকরী ভূমিকা রেখে চলেছে। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথ অনুসরণ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশকে বিশ্বের মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ১৯৯৭ সালে দুর্যোাগ ব্যবস্থাপনার জন্য স্ট্যান্ডিং অর্ডার অন ডিজাস্টার প্রস্তুত করেন।
এখানে দুর্যোাগ ব্যবস্থাপনা সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে বিস্তারিত নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এটি ২০১০ সালে পুনরায় সংশোধন করে যুগোপযোগী করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০১০ সালে ‘বাংলাদেশ জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড’ গঠন করা হয়।
এছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় খুব গুরুত্বপূর্ণ নীতি ও কৌশল প্রস্তুত করা হয়েছে যার মধ্যে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা কর্মসুচি, ২০০৫ এবং বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্ম পরিকল্পনা, ২০০৯ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার সকল উন্নয়ন নীতিমালা ও কর্মকৌশলের মধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তনকে অন্তর্ভূক্ত করেছেন।
এছাড়াও সরকার টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টসমূহ (Sustainable Development Goals- SDGs) অর্জনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রস্তুত করেছে এবং সে অনুযায়ী নীতিমালা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ফলে পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ একই সাথে অর্জন সম্ভব হচ্ছে।
উপসংহারঃ উপরের আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু নিপীড়িত মানুষের মুক্তি ও অধিকার আদায়ের জন্যই সংগ্রাম করেননি, তিনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করতেও সচেষ্ট ছিলেন।
তাঁর সুদূর প্রসারী ও নানামুখী উদ্যোগের কারণে বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশ্বের কাছে আজ আদর্শ। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বাংলাদেশ আজ বিশ্বের নেতৃত্ব দিচ্ছে।
সুন্দরবন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হতে পেরেছে। এই মহান নেতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা যেন পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকালোর মাধ্যমে দেশ গঠনে প্রস্তুত হতে পারি- এই হোক আমাদের আঙ্গিকার।