সেতু নির্মাণের জন্য নদীতে বাঁধ দেওয়া নদী হত্যার শামিল: পরিবেশবীদ
২০০ ফুট প্রস্থের নদীর দুই পাশে বাঁধ দিয়ে মাঝখানে ২০ ফুটের মতো জায়গা ফাঁকা রাখা হয়েছে। এতে পানিপ্রবাহ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
সেতুর পিলারের (খুঁটি) ভিত (বেজমেন্ট) ঢালাইয়ের জন্য নদীর দুই পাশে দেওয়া হয়েছে আড়াআড়ি মাটির বাঁধ। মাঝখানে ২০ ফুটের মতো জায়গা ফাঁকা রাখা হয়েছে। এতে ক্ষীণ ধারার পানিপ্রবাহও প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
‘মৃতপ্রায়’ এ নদীর নাম টেকা। যশোরের অভয়নগর ও মনিরামপুর উপজেলার মাঝামাঝি টেকার ঘাট এলাকায় নদীটির ওপর নির্মাণ করা হচ্ছে গার্ডার সেতু।
পরিবেশবাদী ও নদী রক্ষা আন্দোলনের কর্মীরা বলছেন, সেতু নির্মাণের জন্য এভাবে বাঁধ দেওয়া নদী হত্যার শামিল। কারণ, পরে বাঁধ কেটে দেওয়া হলেও নিচে ভরাট হওয়ার কারণে নদীতে আর আগের পানিপ্রবাহ ফেরে না।
সেতুটি নির্মাণ করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। মনিরামপুরের এলজিইডি সূত্র জানায়, ৫১ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৩ দশমিক ৭ মিটার প্রস্থের পুরোনো সেতু ভেঙে একই স্থানে নতুন সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। এর দৈর্ঘ্য হবে ৯৬ মিটার ও প্রস্থ ৫ দশমিক ৫ মিটার।
এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ কোটি ৫৭ লাখ ২৮ হাজার ৫০৭ টাকা। নির্মাণকাজ পেয়েছে যৌথ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মোজাহার এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড শামীম চাকলাদার (জেভি)। গত বছরের ১৩ অক্টোবর সেতুটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। আগামী বছরের ৭ মার্চ এর কাজ শেষ হওয়ার কথা।
সেতুটি নির্মাণের স্থান থেকে প্রায় ২০০ ফুট উত্তরে নদীর ওপর অস্থায়ী কাঠের সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। প্রায় ২০০ ফুট প্রস্থের নদীটির দুই পাশ ভরাট করার পর মাঝখানে ২৫ ফুটের মতো জায়গা ফাঁকা রাখা হয়েছে।
সেখানে ওপরে তক্তা দিয়ে পাটাতন তৈরি করা। কাঠের সেতুর পশ্চিম পাশ থেকে নির্মাণাধীন সেতু পর্যন্ত নদী বরাবর ভরাট করে তৈরি করা হয়েছে অস্থায়ী রাস্তা। এ রাস্তার শেষ প্রান্তে ১৮ থেকে ২০ ফুট জায়গা ফাঁকা রেখে নদীর দুই দিকে আড়াআড়িভাবে দেওয়া হয়েছে মাটির বাঁধ।
অভয়নগরের গোঘাট এলাকায় মুক্তেশ্বরী নদী থেকে টেকার উৎপত্তি। চার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে নদীটি একই উপজেলার ভবানীপুর এলাকায় শ্রী নদীতে মিশেছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ভবদহ অঞ্চলের পানি ওঠানামা করে মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদী দিয়ে। দখল-দূষণসহ বাঁধ ও স্লুইসগেটের কারণে নদীগুলো নাব্য হারিয়েছে।
ফলে নদী দিয়ে পানি নিষ্কাষিত না হওয়ায় গত বছরের সেপ্টেম্বরের ভারী বৃষ্টিতে অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুরের অন্তত ১২০টি গ্রাম তলিয়ে যায়। অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়েন প্রায় তিন লাখ মানুষ।
স্থানীয় কৃষক জাকির বলেন, টেকা নদী আর নদী নেই, শ্মশান হয়ে গেছে। ব্রিজ করার জন্য নদীর মধ্যে ভরাট করা হয়েছে। এতে নদী শেষ।
পাউবো সূত্র জানায়, ভবদহ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা নিরসনে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বৈদ্যুতিক সেচযন্ত্র দিয়ে টেকা নদী দিয়ে আসা পানি সেচে বের করছে। এ জন্য ভবদহ ২১ ভেন্ট (কপাট) স্লুইসগেটের ওপর ১৪টি ও ৯ ভেন্ট স্লুইসগেটের ওপর ছয়টি বৈদ্যুতিক সেচযন্ত্র বসানো হয়েছে।
পানিপ্রবাহ সচল রাখতে নদীর মধ্যে কমপক্ষে ৫০ ফুট জায়গা ফাঁকা রাখা উচিত উল্লেখ করে পাউবোর যশোর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. তাওহীদুল ইসলাম বলেন, ঠিকাদার সেটি করেননি।
এ জন্য ভবদহ স্লুইসগেটের ওপর বসানো পাম্প (সেচযন্ত্র) পানি পাচ্ছে না। ঠিকাদারকে মাটির বাঁধ অপসারণ করার কথা বললেও তা করা হয়নি।
নদীর মধ্যে পিলার তোলার জন্য কিছুটা ভরাট করা হয়েছে উল্লেখ করে মনিরামপুর উপজেলা প্রকৌশলী বিদ্যুৎ কুমার দাস বলেন, একটা পিলারের বেজ ঢালাই বাকি আছে। ওটা হয়ে গেলে এক্সকাভেটর দিয়ে নদী কেটে দেওয়া হবে। প্রায় একই কথা বলেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মতিয়ার রহমান।
তবে যশোরের কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলনের আহ্বায়ক অনিল বিশ্বাস বলেন, ‘কপোতাক্ষ নদের চারটি সেতু নির্মাণের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সেতু করার সময় নদ-নদীর মধ্যে যে বাঁধ দেওয়া হয়, কাজ শেষ করার পর সাধারণত তা সরানো হয় না।
সরানো হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নদী আর আগের অবস্থায় ফেরে না। টেকা নদীর এ বাঁধ নদীটিকে হত্যা করার শামিল। এ বাঁধ নদীটি ভরাটের প্রক্রিয়া দ্রুততর করবে।’