সুন্দরবনকে বিপদে ফেলে কোনো উন্নয়ন হতে পারে না
সুন্দরবন ধ্বংস করে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা যাবে না। আর লাঠিটিলা বন কেটে সাফারি পার্ক নির্মাণ কোনো উন্নয়ন হতে পারে না। এ উন্নয়ন টেকসই হবে না। বরং পরিবেশ ও জলবায়ুর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করবে।
রবিবার শুরু হওয়া ‘জ্বালানি, জলবায়ু পরিবর্তন ও টেকসই উন্নয়ন’ শীর্ষক সম্মেলনে বক্তারা এসব কথা বলেন। বক্তারা অভিযোগ করেছেন, সরকার পরিবেশ রক্ষা ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে হাঁটছে না। দেশের জনগণের মতামতের ভিত্তিতে টেকসই উন্নয়নের পথে হাঁটার জন্য সরকারকে পরামর্শ দেন বক্তারা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল নেটওয়ার্কের (বেন) যৌথ আয়োজনে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সম্মেলনে মোট ৬০টি প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হবে।
দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে আসা পরিবেশবাদী সংগঠন ও ব্যক্তিরা এতে অংশ নিচ্ছেন। এ সম্মেলন মূলত ভার্চ্যুয়ালি হচ্ছে। তবে রাজধানীর স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইস্কাটান ক্যাম্পাসে মূল আয়োজনস্থলে আলোচকেরা উপস্থিত ছিলেন।
বাপার সদস্য ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশের জন্য জ্বালানি পরিকল্পনা করে প্রয়োজন অনুযায়ী উৎপাদন করা একটি জটিল হিসাবের কাজ।
সরকারের অন্যান্য কাজে যেমন প্রকল্পভিত্তিক ও বিদেশি পরামর্শকভিত্তিক সমাধান করা হয়, জ্বালানির ক্ষেত্রে তা করা যাবে না। কারণ এ ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তন, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। ফলে জ্বালানি নিরাপত্তার পরিকল্পনায় সব ধরনরে মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, অনেক সময় সরকারের কাছে অর্থনৈতিক যুক্তির চেয়ে রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন গুরুত্বপূর্ণ হয় ওঠে। সে ক্ষেত্রে অনেক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না।
কিন্তু এখানে জ্বালানি ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজের ক্ষেত্রে অর্থনীতি ও পরিবেশকে গুরুত্ব দিতে হবে। পরিকল্পিত শিল্পায়ন ও ইটভাটার কারণে বায়ু ও পানিদূষণ ব্যাপক হারে বাড়ছে। এ দূষণ ক্যানসারসহ নানা ধরনের রোগবালাই বাড়িয়ে দিচ্ছে। গ্রামের গরিব মানুষের মধ্যেও এখন ক্যানসার রোগীদের ঢাকায় চিকিৎসা নিতে আসতে দেখা যাচ্ছে। ফলে সামগ্রিকভাবে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ সুরক্ষা ও জ্বালানি নিরাপত্তাকে একসঙ্গে মিলিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে।
সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘বৈদেশিক নির্ভরতা আমাদের পীড়া দেয়। এই সরকারের অন্যতম অর্জন হচ্ছে বৈদেশিক নির্ভরতা কমিয়ে আনা।
সরকারের সব কাজে কৃচ্ছ্র সাধন করা যায়নি। রামপালসহ বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সারা দেশের মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে। সবার মুখে হাসি ফুটেছে।’
বাপা সভাপতি সুলতানা কামাল বলেন, ‘ভোটের জন্য যদি জনগণের কাছে যেতে হয়, তাহলে তাঁদের মতামতের ভিত্তিতে উন্নয়ন পরিকল্পনা নিতে হবে।
একটা অঞ্চলের জন্য উন্নয়নের ধারণক্ষমতা কতটুকু, তা–ও বিবেচনা করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে রামপাল নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু এ নিয়ে যে অস্বচ্ছতা আছে, তা দূর করা হয়নি। চার বছর আগে আমরা রামপাল নিয়ে ১৩টি বৈজ্ঞানিক গবেষণা সরকারের কাছে তুলে দিয়েছি, কিন্তু সরকার তার অবস্থান পরিষ্কার করেনি।’
সুলতানা কামাল আরো বলেন, মৌলভীবাজারে লাঠিটিলায় সংরক্ষিত বন কেটে সাফারি পার্ক করা হচ্ছে। সেখানকার জনপ্রতিনিধি বলছেন, ‘কষ্ট করে প্রকল্প এনেছি।’
কিন্তু এ প্রকল্প কার জন্য, কিসের বিনিময়ে তা বিবেচনা করা হচ্ছে না। তিনি বঙ্গবন্ধুর বন রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়ার একটি উদাহরণ টেনে বলেন, সরকার পরিবেশ ও বন রক্ষায় বঙ্গবন্ধুর ওই পথ ধরে হাঁটছে না।
বেনের সমন্বয়ক অধ্যাপক নজরুল ইসলাম সম্মেলনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য টেকসই ও জনগণের চাহিদার কথা চিন্তা করে পরিকল্পনা করতেন। কিন্তু সরকারের জ্বালানি নীতি সেই পথে এগোচ্ছে না।
সরকার বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ১২ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এটা বাজেটে চাপ বাড়াচ্ছে। ২০১৮ সাল থেকে ৪০ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। তার মানে আমাদের বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনায় গলদ আছে। মুখে বলা হচ্ছে, নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে গুরুত্ব দেওয়া হবে, বাস্তবে গুরুত্ব পাচ্ছে কয়লা।’
সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনের পর কারিগরি অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী। তিনি বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছরে অনেক অর্জন করেছে।
কিন্তু সামনের ৫০ বছর কীভাবে এগোবে, সেই লক্ষ্য নির্ধারণে এ আলোচনাগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। আগামী দিনের বাংলাদেশ যাতে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই হয়, সে জন্য এ সম্মেলনের সুপারিশগুলোকে আমলে নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে তা উপস্থাপনের পরামর্শ দেন তিনি।
বাপার সদস্য ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান কারিগরি অধিবেশনে সূচনা বক্তব্য দেন। আর আলোচনা করেন যুক্তরাষ্ট্রের লকহেড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক খালেকুজ্জামান