সিসা তৈরির কারখানার প্রভাবে হুমকির মুখে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য
ঢাকার কেরানীগঞ্জে সবুজে ঘেরা পরিবেশ প্রকৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে সিসা তৈরির কারখানা। যা যথারীতি গিলে খাচ্ছে জীববৈচিত্র্য।
কারখানায় দিনে এবং রাতের আঁধারে পোড়ানো ব্যাটারি থেকে নির্গত রাসায়নিক পদার্থের বিষক্রিয়া বাতাসের সঙ্গে মিশে ছড়িয়ে পড়ছে প্রকৃতিতে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে এ এলাকায় বসবাসরত মানুষসহ গাছপালা, ফল ও পশুপাখি।
আবাদী জমির উপর চারদিকে টিন দ্বারা বেষ্টিত ওই কারখানায় ৮ থেকে ১০ জন লোক সিসা তৈরির পূর্ব প্রস্তুতিমূলক কাজ করছিল। তাদের মধ্যে কেউ পুরানো ব্যাটারির উপরের অংশ তুলে ফেলছে, আবার কেউ ব্যাটারির ভেতর থেকে সিসা জাতীয় ধাতব পদার্থ বের করছে।
তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছয় থেকে আট হাজার টাকা বেতনে কাজ করছে তারা। দিনে একদল শ্রমিক ব্যাটারি থেকে এসব ধাতব পদার্থ বের করে, রাতে আরেকদল শ্রমিক সেগুলো মাটির গর্তে ফেলে পুড়িয়ে একটি ঘন পাত্রের রূপ দেয়। পরে সেই ঘন পাত্রগুলোকে বিভিন্ন বড় বড় ব্যাটারি তৈরি কারখানায় বিক্রয় করা হয়।
এলাকাবাসীর তথ্য মতে, উপজেলার খোলামুড়া, শুভাঢ্যা পশ্চিমপাড়া রতনের খামার, বিলকাঠুরিয়া ও চিতাখোলা এলাকাসহ নির্জন এলাকায় গড়ে উঠেছে ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা তৈরির একাধিক কারখানা। একেবারে উন্মুক্ত পরিবেশে কোনো ধরনের কাগজপত্র ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে কার্যক্রম চালিয়ে আসছে কারখানাগুলো।
কর্মরত মামুন আলী নামের একজন শ্রমিক জানান, পুরাতন ব্যাটারি কিনে ওগুলোর কোষ আলাদা করার পর একটি চুল্লির ভেতর কাঠ ও কয়লা দিয়ে স্তরে ব্যাটারির কোষগুলো সাজিয়ে উচ্চ তাপ সৃষ্টি করা হয়।
ফলে ব্যাটারির কোষে থাকা সিসা গলে চুল্লির নিচের স্তরে জমা হয় সেখান থেকে বড় হাতল দিয়ে সিসা নির্দিষ্ট ডাইসে ভরা হয়। তৈরিকৃত ২৫ থেকে ৩০ কেজি ওজনের ওসব সিসার ডাইস টন প্রতি ৪০ থেকে ৮০ হাজার টাকা দরে বিভিন্ন ব্যাটারি তৈরির কারখানায় বিক্রি হয় বলেও তিনি জানান।
রফিক নামে আরেক শ্রমিক জানান, সিসা চকচক করে তবে দিনের বেলা সিসা ও বর্জ্য চেনা যায় না। এজন্য রাতে সিসা গলানো হয়। সিসা ফ্যাক্টরিগুলো সারাদিন বন্ধ থাকে মধ্যরাতে গাড়িতে করে মালামাল এনে কাজ শুরু হয়।
আবার ভোর হওয়ার আগেই কাজ শেষ হয়ে যায়। রাতে কাজ করার সময় শ্বাস নিতে অনেক কষ্ট হয়। সিসা তৈরির সঙ্গে যুক্ত আরও কয়েকজন ব্যক্তি জানান, পরিত্যক্ত ব্যাটারির কোষগুলো সিমেন্টের মতো জমাট বেঁধে যায়।
চুল্লির মধ্যে অ্যাসিড মিশ্রিত জমাট বাঁধা বর্জ্য সাজানো হয়। এরপর কাঠ ও কয়লা দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে একটি পাম্পের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক পাখা দিয়ে প্রচ- বেগে বাতাস দেওয়া হয়।
কাঠ ও কয়লা পুড়ে একটি আগুনের কু-লী সৃষ্টি হয়। সিসা পুড়ে তরল হয়। এরপর একটি লম্বা চামচ দিয়ে বর্জ্য সরিয়ে সিসা লোহার তৈরি কড়াইতে রাখা হয়। ঘন ধূসর ধোঁয়া চিমনি দিয়ে বের হয়ে যায়।
বিলকাঠুরিয়া এলাকার বাসিন্দা গোলাম মোস্তফা জানান, সিসা ফ্যাক্টরির কারণে গাছপালা পাতা বিবর্ণ হয়ে ফ্যাকাসে হয়ে যায়। ফসলের ক্ষতি, গবাদি পশু প্রাণহানি ঘটতে পারে। সিসা উচ্চ তাপমাত্রায় গলানোর সময় সহযোগী হিসেবে কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইডসহ বিভিন্ন ক্ষতিকারক যৌগ উৎপাদিত হয় এবং তা দ্রুত বাতাসে সঙ্গে চারদিকে ছড়ায়। এতে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে।
শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ দেখা দিচ্ছে। হারুন মোল্লা নামে আরেক ব্যক্তি বলেন, গত কয়েক দিনে কারখানার আশপাশে গরুকে ঘাস খাওয়ানোর কারণে বেশ কয়েকটি গরু রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এতে করে মারাত্মকভাবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও প্রশাসন তাদের দিকে নজর দেয়নি।
এসব কারখানা বন্ধের ব্যাপারে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) পরিবেশ বিজ্ঞান অনুষদের প্রভাষক নন্দিতা সরকার বলেন, আবাসিক এলাকায় এসব কারখানা গড়ে উঠা মোটেও ঠিক হয়নি।
ব্যাটারিতে এসিড জাতীয় পদার্থ থাকে যা হাতে লাগলে মানুষের ক্ষতি হয়। বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বা নারীর গর্ভের শিশুর উপর প্রভাব ফেলে।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মুহম্মদ মশিউর রহমান বলছেন, এ ধরনের পদার্থ মানুষের শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ ও ক্যান্সারের মতো রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। শিগগিরই অবৈধ
কারখানাগুলোতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মেহেদী হাসান।