শিশুর বাল্যকাল ক্রমশ কেড়ে নিচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে যেন কারো নিস্তার নেই। সন্দেহ নেই, জলবায়ু পরিবর্তন শিশুর বাল্যকাল কেড়ে নিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে কৃষকের আয় কমে যাচ্ছে।
খেটে খাওয়া মানুষরা কাজ হারিয়ে দারিদ্র্যের কবলে পড়ছে। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে শিশুদের ওপর। দরিদ্র পরিবারের শিশুরা নিজের বেঁচে থাকার তাগিদে ও পরিবারের জন্য কাজে নেমে পড়তে বাধ্য হচ্ছে।
উপকূলের হাজার হাজার শিশু মাছ ধরার কাজে নেমে পড়েছে। অনেক শিশু অন্যের নৌকায় কাজ করে দরিদ্র পরিবারের হাতে টাকা তুলে দিচ্ছে। অনেক পরিবারের অভিভাবক শিশুকে তার নিজের কাজের সঙ্গে যুক্ত করেছে।
বহু পরিবার শিশুসন্তানকে শহরে পাঠিয়ে কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। শিশুদের নিয়ে উপকূলীয় পরিবারগুলোতে সচেতনতা কম। আর সচেতনতা কম হবেই বা না কেন? জলবায়ু পরিবর্তন যেখানে পুরো জীবনব্যবস্থাকে এলোমেলো করে দিয়েছে এবং দিচ্ছে সেখানে সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর সময় কোথায়?
জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হওয়া দরিদ্র পরিবারের শিশুরা অপুষ্টি ও বিভিন্ন রোগ-ব্যাধির শিকার। বহু শিশু স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত। দরিদ্র পরিবারের বহু শিশু কাজে যুক্ত হওয়ার কারণে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি শিকার হয়ে যারা ভিটেমাটি ছেড়ে পরিবারের সঙ্গে শহরে পাড়ি জমাচ্ছে, সেসব শিশুর অবস্থা বোধ করি আরও ভয়াবহ! পরিবারের সঙ্গে জলবায়ু উদ্বাস্তু শিশুদের ঠাঁই হচ্ছে শহরের কোনো বস্তিতে। শহরে এসেও এসব শিশু আর লেখাপড়ার জগতে ফিরে যাচ্ছে না!
পরিবারের অভিভাবকরা শহরের কোনো ছোট-বড় কারখানায় কিংবা ছোট্ট পেশায় শিশুকে কাজে লাগিয়ে দিচ্ছে। অনেক শিশু লেখাপড়া বাদ দেয়ার ফলে বিপথে চলে যাচ্ছে। অনেকে অল্প বয়স থেকে মাদক গ্রহণে আসক্ত হয়ে পড়ছে।
স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গেও বহু শিশু নিজেদের জড়িয়ে ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কবলে পড়ে একটু একটু করে হাজার হাজার শিশুর বাল্যকাল হারিয়ে যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মতে, বিশ্বে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৬ সালের এক জরিপ বলছে, দেশে বিভিন্ন খাতে শিশুশ্রমে নিযুক্ত প্রায় ৩৪ লাখ শিশু।
করোনাকালীন বাস্তবতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজনিত সমস্যায় বর্তমানে এ সংখ্যা ৪০ লাখের ওপরে। শিশুশ্রমের সঙ্গে যুক্ত অর্ধেক শিশুই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যার শিকার।
খরা, ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততার প্রভাব কোনো না কোনোভাবে শিশুর বাল্যকাল কেড়ে নিচ্ছে। আর বাল্যকাল যার নষ্ট হয়ে যায় সন্দেহ নেই পুরো জীবনটাই তার এলোমেলো।
যে সময়ে শিশুর হাতে বই থাকার কথা, যে সময়ে বিদ্যালয়ের বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা করার কথা সেই সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দারিদ্র্যের কবলে পড়ে হাজার হাজার শিশু শিশুশ্রমে নিযুক্ত হতে বাধ্য হচ্ছে।
বাল্যকাল যাদের দারিদ্র্যের কষাঘাতে বন্দি, যারা শিশুশ্রমের সঙ্গে যুক্ত কেউ তাদের খোঁজ নেয় না। কেউ তাদের ঘরে ফেরানোর উদ্যোগ নেয় না। শতভাগ শিশু যেখানে স্কুলে থাকার কথা উপকূলের শত শত শিশু তখন বিদ্যালয় বাদ দিয়ে আয়-রোজগারে ব্যস্ত।
শিশুর বাল্যকাল হারিয়ে গেলে তা পুরো দেশের উন্নয়নের পথে অন্তরায়। কোনো শিশুর ভবিষ্যৎ জলবায়ু পরিবর্তন ও দারিদ্র্যের কারণে নষ্ট হোক- এটা কারোরই কাম্য নয়। প্রতিটি শিশুই সম্ভাবনাময় ও দেশের ভবিষ্যৎ সম্পদ।
উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের যেসব এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি, সেসব এলাকায় শিশুবান্ধব পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। সকাল ৮টা বাজলে সব শিশু বাধ্যতামূলক স্কুলে থাকবে- সংশ্লিষ্ট এলাকায় এমন নিয়মও চালু করলে ও শিশুদের লেখাপড়ার সুবিধাসহ সার্বিক সহযোগিতা করলে শিশুশ্রম কমে আসবে।
প্রতিদিন কোনো না কোনো শিশুর বাল্যকাল জলবায়ু সমস্যার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা যে অচিরেই শেষ হয়ে যাবে, এমনটি ভাবার কারণ নেই। সমস্যা গভীরভাবে অনুধাবন করে সমাধানের পথ বের না করলে আগামীতে পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যার শিকার শিশুদের রক্ষার দায়িত্ব সরকারসহ সবার। একদিকে জলবায়ু সমস্যার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো ও মোকাবিলা করার উপায় খুঁজতে হবে অন্যদিকে নতুন করে আর একটি শিশুর বাল্যকাল যেন জলবায়ুগত সমস্যায় হারিয়ে না যায়, সেদিকে গুরুত্বরোপ করতে হবে।