আমাদের একটি ছোট পাহাড়ে রোহিঙ্গা শিবির স্থাপন। টেকনাফ ও উখিয়ার এ রকম বহু পাহাড়ের গাছ ও মাটি কেটে শিবির তৈরি করা হয়েছে। এলাকায় বসবাসকারীদের রান্নার কাঠও আসছে বন থেকে। যে এলাকায় এই শিবিরগুলো গড়ে উঠছে, সেখানে ছিল বন্য প্রাণীদের বসতি। রোহিঙ্গা শিবিরগুলো ওই এলাকার জীববৈচিত্র্যকে মারাত্মক হুমকির দিকে ঠেলে দিয়েছে। তবুও মানবতার প্রশ্নে বাংলাদেশ এগিয়ে। কিন্তু আমাদের দেশের জীববৈচিত্র ধ্বংস কমিয়ে আনা প্রয়োজন। বিভিন্ন সংগঠন ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য মোতাবেক অনেক তথ্য জানা গেছে সেখানকার জীববৈচিত্র্য ধ্বংস সম্পর্কে।
বন বিভাগ থেকে শুরু করে জীববৈচিত্র্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও রোহিঙ্গা শিবিরের কারণে বন ধ্বংসের কথা বিভিন্ন সময় জানিয়েছে। তাদের পর্যবেক্ষণেও জীববৈচিত্র্য হুমকির চিত্র নানাভাবে উঠে এসেছে। যা আমাদের সবার জানা। কিন্তু কিভাবে এই সমস্যা সমাধান করা যায় তা নিয়ে সরকার সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ভূমিকা পালন করছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এ পদক্ষেপ কতটা সুফল দিবে আমাদের জীববৈচিত্র্য রক্ষার ক্ষেত্রে।
২০১৭ সালে রোহিঙ্গা শিবির স্থাপন নিয়ে জাতিসংঘ উন্নয়ন তহবিলের (ইউএনডিপি) ‘দ্রুত পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন’ বলছে, রোহিঙ্গা শিবিরগুলো দেশের জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বসতি গড়ে ওঠার বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে সেখানে কিছু প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসভূমি চিরতরে হারিয়ে যাবে। বন আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যাবে না। আর ভূমির ক্ষতিও অল্প সময়ে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। এই পরিস্থিতিতে শুধু বাংলাদেশ নয়, রোহিঙ্গা শিবিরগুলো বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্যের জন্যও এখন বড় হুমকি।
ইউএনডিপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, রোহিঙ্গাদের শিবিরগুলো প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন স্বীকৃত তিনটি এলাকার প্রকৃতি ধ্বংস করছে। এগুলো হচ্ছে টেকনাফ উপদ্বীপের উপকূল এলাকা, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ও সোনাদিয়া দ্বীপ। এ ছাড়া শিবিরগুলোর কাছে আছে দুটি সংরক্ষিত এলাকা—হিমছড়ি ন্যাশনাল পার্ক ও টেকনাফ অভয়ারণ্য। প্রস্তাবিত ইনানি ন্যাশনাল পার্কও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সব মিলিয়ে গোটা এলাকায় ১ হাজার ১৫৬ প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী আছে। গুরুত্বপূর্ণ বন্য প্রাণীর তালিকায় আছে হাতি, হরিণ, ছোট ভারতীয় বনবিড়াল, বড় ভারতীয় বনবিড়াল ও বন্য শূকর। এর মধ্যে হাতি খুব বিপন্ন এবং হরিণ বিপন্ন পরিস্থিতিতে আছে। দুই প্রজাতির বিড়াল প্রায় ঝুঁকিতে। বন্য শূকর নিয়ে উদ্বেগ কম।
কী আছে এই অঞ্চলে
কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত পাহাড় আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পাহাড়ি এলাকা ও টেকনাফ উপদ্বীপ পরিযায়ী পাখির আন্তর্জাতিক উড়ালপথের অংশ। মধ্য এশিয়া ও পূর্ব এশিয়া এবং অস্ট্রেলেশিয়ার মধ্যকার উড়ালপথের মাঝে এই অঞ্চল। দীর্ঘ পথ ওড়ার পর এখানে কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে পাখিরা পূর্ব থেকে পশ্চিমে বা মৌসুমিভেদে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে উড়ে যায়। শিবির স্থাপনে এতে কিছু প্রজাতির পাখি বিপন্ন হয়েছে।
ইউএনডিপির প্রতিবেদন বল হয়েছিলো, সমুদ্র উপকূল ও পাহাড় একই সঙ্গে থাকায় এই অঞ্চল জীববৈচিত্র্যে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস এই বৈচিত্র্য রক্ষায় সহায়তা করে। এই এলাকায় আছে বহু প্রজাতির উদ্ভিদ। এর মধ্যে ১৪৩ বৃক্ষ, ১১৩ গুল্ম, ১৮৪ তৃণলতা, ৮৭ লতা ও এক প্রজাতির পরজীবী উদ্ভিদ। এ ছাড়া আছে ১৯৮ প্রজাতির অমেরুদণ্ডী প্রাণী, মাছ ৪৮, উভচর ২৭, সরীসৃপ ৫৪, পাখি ২৪৩ ও স্তন্যপায়ী ৪৩ প্রজাতির।
রোহিঙ্গা সমস্যা শুধু আমাদের সমস্যা , নাকি আন্তর্জাতিক ?
রোহিঙ্গা সমস্যা শুধু আমাদের দেশের সমস্যা নয় এটি একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। রোহিঙ্গা শিবির স্থাপন করার ফলে সেখানকার জীববৈচিত্র্য অনেক ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু এই সমস্যা সৃষ্টির মূলে রয়েছে মিয়ানমার। এই সমস্যা আন্তর্জাতিক পরিবেশকে বিভিন্নভাবে ক্ষতি করছে। আগুনে পুড়ে আমাজন বনের অনেক ক্ষতি হয়েছে। এটি কি বনের ক্ষতি নাকি আমাদের ক্ষতি সেটি বিশ্ববাসী ঠিকমতো বুঝেতে পেরেছি। কিন্তু বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শিবির স্থাপনের ফলে আমাদের দেশের জীববৈচিত্র্যর যে ক্ষতি হয়েছে এটি কি শুধু আমাদের দেশের ক্ষতি অবশ্যই না এটি আন্তর্জাতিক পরিবেশগত ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি। সুতরাং রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো সহ সকল দেশকে এগিয়ে আসতে হবে। রোহিঙ্গাদের তাদের আবাসভূমিতে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে চাপ সৃষ্টি করতে হবে। কারণ রোহিঙ্গারা বনের উপরে নির্ভর করে বেঁচে আছে প্রতিদিন বনের ক্ষতি করেই চলেছে। যা রোহিঙ্গাদের তাদের আবাসভূমিতে ফিরে যাওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
লেখক : মোঃ রাজিবুল ইসলাম