বাড়ছে মাটির তাপমাত্র। রাজধানী ঢাকায় পূর্বের তুলনায় বর্তমানে গাছের সংথ্যা নেই বললেই চলে। আর জলধারার কথা তো বলাই যাবে না। যেটুকু জলধারা আছে তাও আবার অপরিষ্কার। যদিও বর্তমানে রাজধানী ঢাকা শহরের রুপবৈচিত্র ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু হচ্ছে সম্ভভ হবে না আর আগের মতো। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে বাড়ির ছাদে করা হচ্ছে বাগান । যাকে আমরা বলছি ছাদ কৃষি। শহরের জলধারাও ধরে রাখার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। অপরিকল্পিত এ শহরের নিজ দায়িত্ব নিয়ে যদি কাজ করে তাহলে হয়তো কিছুটা হলেও তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকবে। দেখা যাচ্ছে শহরের আশপাশ ঘিরে থাকা সবুজ বনায়ন কেটে বানানো হচ্ছে অট্টালিকা যা আমাদের পরিবেশকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাপমাত্রা বৃদ্ধি কমানোর জন্য যদি সামগ্রিকভাবে কাজ করা যায় তাহলে হয়তো সমস্যার কিছুটা হলেও সামাধান হবে বলে আশা করা যায়।
‘গ্লোবাল লিভঅ্যাবিলিটি ইনডেক্স’ অনুযায়ী, বিশ্বে বসবাসের অনুপযোগী শহরগুলোর তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে আছে আমাদের রাজধানী ঢাকা। এদিকে নগর বিশেষজ্ঞরা জানালেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণই এর মূল কারণ। আর এমন নগরায়ণের কারণে বছর বছর ঢাকার ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রাও বেড়ে চলেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর গবেষণা অনুযায়ী দেখা গেছে গত ১৮ বছরে ঢাকা শহরের ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা চার থেকে সাড়ে পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভাটারা এলাকায়।
নগর–পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আকতার মাহমুদ জানালেন, ‘বৈশ্বিক তাপমাত্রা দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লেই আবহাওয়ায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়। মাটির তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি বাড়লেই জনজীবনে ব্যাপক অস্বস্তির সৃষ্টি হয়। সেখানে ৪-৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়া খুবই আশঙ্কাজনক। এর নেতিবাচক প্রভাব আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সব ক্ষেত্রেই পড়বে।’
ঢাকা শহরের মাটির তাপমাত্রা এত বাড়ার কারণ সম্পর্কে নগর বিশেষজ্ঞরা জানালেন, একটি শহরে শুধু ঘরবাড়িই থাকবে না, প্রয়োজন অনুযায়ী কৃষিজমি, সবুজ অঞ্চল, উন্মুক্ত স্থান ও জলাধার রাখতে হবে। কিন্তু ঢাকা শহরে কৃষিজমি অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। জলাধার যা ছিল, তারও বড় একটি অংশ ভরাট করা হয়েছে। যার ফলে তাপমাত্রা বেড়েছে ভূপৃষ্ঠের ।
হাসান মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির পেছনে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, ‘বিল্ট-আপ এরিয়া বৃদ্ধি, জলাভূমি কমিয়ে আনা, ঘনবসতিসহ নানা বিষয় জড়িত রয়েছে। এর মধ্যে বেশি দায়ী জলাভূমি কমে যাওয়া। হাসান মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আরো বলেন, ‘মানবদেহের কিডনির মতো জলাভূমি একটি শহরের কিডনি হিসেবে কাজ করে। শহরের জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা কমাতেও এটি অগ্রণী ভূমিকা রাখে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ঢাকা শহরের জলাভূমির বেশির ভাগই এখন ভরাট করা হয়েছে।’
মাহবুবা মেহরুনের গবেষণা অনুযায়ী, ১৯৯০ সালে ঢাকা শহরের মোট ভূমির ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ ছিল জলাভূমি, আর বিল্ট-আপ এরিয়া ছিল মাত্র ৮ শতাংশ। ২০১৫ সালে জলাভূমি কমে হয়েছে মাত্র ৬ শতাংশ, আর বিল্ট-আপ এরিয়া বেড়ে হয়েছে ৩৮ দশমিক ২৬ শতাংশ।
গবেষণা অনুযায়ী, ১৯৯০ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা শহরে ভূপৃষ্ঠের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৯ দশমিক ৯৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ২৪ দশমিক ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।কিন্তু এই সময়ে ঢাকার ৮০ শতাংশের বেশি এলাকার মাটির তাপমাত্রা ১৫-১৮ ডিগ্রির সেলসিয়াসের মধ্যে ছিলো। আর ২০০০ সালের জানুয়ারিতে মাটির তাপমাত্রা সর্বনিম্ন ১৪ দশমিক ৭১ এবং সর্বোচ্চ ২৩ দশমিক ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।২০১৯ সালের জানুয়ারিতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা হয় ১৮ দশমিক ৮০ এবং সর্বোচ্চ হয় ২৮ দশমিক ৭৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এখন ঢাকার ৮০ শতাংশের বেশি এলাকার মাটির তাপ ২১-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে।
৮০ শতাংশের বেশি এলাকার মাটির তাপ ২১-৩০ ডিগ্রি হওয়ার কারণ সম্পর্কে গবেষণায় নেতৃত্ব দেওয়া হাসান মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, ঢাকা শহরের নগরায়ণ পরিকল্পিতভাবে হয়নি। বেশির ভাগ এলাকাই গড়ে উঠেছে জলাভূমি ভরাট। ভরাটের জন্য ব্যবহার করা বালু অতিমাত্রায় তাপ শোষণ করে, যার ফলে ঢাকা শহরের বেশির ভাগ এলাকার ভূমির তাপমাত্রা বেশি।
গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, মাটির তাপ বাড়ার কারণে শহরের আবহাওয়াও উষ্ণ হয়। এতে মানুষের স্বাস্থ্যগত নানা সমস্যা দেখা দেয়, চলাচলে মানুষের অস্বস্তি বাড়ে। এ ছাড়া গরম থেকে প্রশান্তির জন্য বৈদ্যুতিক পাখা ও শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ে। এতে অর্থনীতিতেও প্রভাব পড়ে।
এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় সম্পর্কে জানতে চাইলে হাসান মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, ঢাকা শহরের সবুজ অঞ্চল, পার্ক, উন্মুক্ত স্থান, গাছপালা যেটুকু আছে, তা আর কোনোভাবেই নষ্ট করা যাবে না। যেকোনো ভাবে জলাভূমিগুলো রক্ষা করতে হবে। পাশাপাশি বাড়ির ছাদে বাগান করলেও সেটি তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করবে। আর এসব না করলে ঢাকা শহরের মাটির তাপ আরও বাড়বে। এতে করে শহরে বাস করাই কঠিন হয়ে পড়বে।