মাথার ওপর মিথেন বিপদ : মাতুয়াইল ল্যান্ডফিল্ডকেই প্রধান উৎস বলা হচ্ছে
দেশের বাতাসে হঠাৎ করেই বেড়েছে উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি। গত ১৭ এপ্রিলের হুগো স্যাটেলাইটের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে প্যারিসভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘কায়রস এসএস’র এক প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বলা হয়েছে, বিশ্বের শীর্ষ ১২টি মিথেন নিঃসরণের হার শনাক্ত হয়েছে যাতে বাংলাদেশের বাতাসে ঘন মিথেন গ্যাসের রহস্যজনক ধোঁয়ার উপস্থিতি মিলেছে। দেশের বায়ুমণ্ডলে মিথেনের এই উপস্থিতিকে উদ্বেগের বলছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই মিথেন হঠাৎ করেই বাড়ার কারণ বের করে তার প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে হবে, আর তা সম্ভব না হলে অকল্পনীয় স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বে দেশ। এমনকি অধিক হারে অ্যাসিড রেইন বা অম্ল বৃষ্টিও হতে পারে, যা মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে দেশের প্রকৃতি ও পরিবেশের।
গ্রিনহাউস গ্যাসগুলোর মধ্যে ঘ্রাণহীন বর্ণহীন এই মিথেন গ্যাস অন্যতম শক্তিশালী। এটি গত দুই দশকে বৈশ্বিক উষ্ণতা আরও দ্রুত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয় যা কার্বন ডাই অক্সাইডের থেকেও ৮৪ গুণ বেশি ক্ষতি করেছে বায়ুমণ্ডলের।
হুগো স্যাটেলাইটের মাধ্যমে জানা যায় যে, বাংলাদেশের মাতুয়াইল স্যানিটারি ল্যান্ডফিল থেকে এতো বেশী পরিমাণ মিথেন নিঃসরণ হচ্ছে যার নিয়মিত সঠিক পরিসংখ্যান নেই তবে পরিমাণ হিসাবে বলতে গেলে ঘণ্টায় প্রায় চার হাজার কেজি। সহজ ভাবে বলতে গেলে ১৮১ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত মাতুয়াইল স্যানিটারি ল্যান্ডফিলে প্রতিদিন প্রায় আড়াই হাজার টন বর্জ্য ফেলা হয় আর এর থেকে প্রতি এক ঘণ্টায় এক লাখ নব্বই হাজার গাড়ি যে পরিমাণ বায়ুদূষণ ঘটায়, তার সমপরিমান বায়ুদূষণ হচ্ছে এই ময়লার ভাগাড় থেকে।
তবে পরিবেশবিদরা বলছেন, আকাশে মিথেনের যে আস্তরণ রয়েছে তা অনেক কারনেই হতে পারে বা অন্য দেশ থেকেও নিঃসরণ হয়ে বাতাসে ভেসে এখানে জড়ো হতে পারে তবে এ নিয়ে অনেক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
নিঃসরণের সঠিক মাত্রা নির্ণয় ও উৎস শনাক্ত করা ছাড়া এ সংকট সমাধানের উপায় নেই। এ নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করে পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, এই বিষয়ে এখনই অনুমানভিত্তিক কিছু বলা যাবে না। একটা টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হয়েছে তাদের রিপোর্টটা পাওয়ার আগ পর্যন্ত স্পষ্ট কিছু বলা যাবে না, একটু অপেক্ষা করতে হবে।
ইউরোপীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার (ইএসএ) সেন্টিনেল-ফাইভপি ও সেন্টিনেল-টু স্যাটেলাইটের তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মিথেন নিঃসরণে সবচেয়ে বেশি দায়ী ধানক্ষেত, ময়লার ভাগাড়, প্রাকৃতিক গ্যাসের পাইপলাইনে ফাটল, কয়লা পোড়ানোসহ নানা কারণ। যার ফলে আমাদের এখানে যতটুকু গরম পড়ার কথা তার চেয়ে বেশি গরম পড়ে। ধান পুড়ে যাওয়া বা হিটশক হতে পারে এই মিথেনের কারণে ।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, ‘বাংলাদেশ বিষয়টি সম্পর্কে ফর্ব থেকেই সচেতন। আমাদের এখানে সিংহভাগ মিথেনই ধানক্ষেত থেকে তৈরি হয়। যখন চাষিরা জমিতে পানি দেয়, তখন মাটিতে থাকা ব্যাকটেরিয়া বিপুল পরিমাণ গ্যাস সৃষ্টি করে। এছাড়া জীবাশ্ম জ্বালানি এর অন্য একটা উৎস। আরেকটা উৎস হচ্ছে ল্যান্ডফিল গ্যাস। আমরা এটি কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, ‘স্যাটেলাইট থেকে এই মিথেনের লেয়ার পাওয়া গেছে। এটার জন্য ল্যান্ডফিল একটা কারণ হতে পারে। আবার জলাশয় ভরাট, কৃষিজমি, বনভূমি কিংবা অন্য জায়গা থেকে মিথেন এসে এক যায়গায় কনসেনট্রেশন হতে পারে। এটার একটা স্টাডি হওয়া দরকার এবং এই গ্যাস নিঃসরণের ক্ষেত্রে সরকারের নীতিগত পদক্ষেপ নিতে হবে। ’
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘মিথেনের ৫-৬টা উৎস থাকে।
১. সমুদ্র থেকে আসে তবে বাংলাদেশের সমুদ্রোপকূল থেকে কোনো মিথেন হয় না।
২. অ্যাগ্রিকালচারাল ওয়েস্ট থেকে মিথেন আসে। স্যাটেলাইটের যে স্টাডিটা হয়েছে, সেটা ফেব্রুয়ারি বা মার্চে হয়েছে। সে সময়ে শীতকাল ছিল, সুতরাং সেখান থেকে মিথেন আসার সুযোগ নেই। যখন চাষিরা জমিতে পানি দেয়, তখন মাটিতে থাকা ব্যাকটেরিয়া বিপুল পরিমাণ মিথেন গ্যাস সৃষ্টি করে।
৩. কয়লাখনি থেকে মিথেন তৈরি হয়। কিন্তু বাংলাদেশ সেরকম কোনো কয়লাখনিও নেই।
৪. তেলের খনি কিংবা গ্যাসের খনি লিক করেও মিথেন নির্গত হয়। এমন কোনো ঘটনাও ঘটেনি আমাদের বাংলাদেশে।
৫. গবাদি পশুর মল থেকেও মিথেন হয়, সেটা বাংলাদেশে মডারেট পর্যায়ে আছে।’
৬. জীবাশ্ম জ্বালানি এর অন্য একটা উৎস। বাংলাদেশে প্রচুর ময়লা-আবর্জনা খোলামেলা পোড়ানো হয়, ফেলে রাখা হয়। এটাও মিথেনের বড় একটা উৎস।
৭. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ যেটা হচ্ছে ল্যান্ডফিল গ্যাস। ওয়েস্ট ডাম্পিং সাইট (ল্যান্ডফিল) থেকে প্রচুর মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। আমাদের যশোর, কুষ্টিয়া, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকার ল্যান্ডফিল্ড থেকে প্রচুর গ্যাস জেনারেট হয় এবং সেই গ্যাসটা ১০০ ভাগ মিথেন। এই ল্যান্ডফিলগুলোর কোনো ম্যানেজমেন্ট নেই। এটা বায়ূদূষণ করছে।
গত ২২-২৩ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আয়োজনে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত হয়েছে জলবায়ুবিষয়ক ‘লিডার্স সামিট’। এতে অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। এছাড়া ৪০ জন বিশ্বনেতাও এ সম্মেলনে যোগ দেন। ওই সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানাতে ৯ এপিল ঢাকায় ঝটিকা সফরে এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জলবায়ুবিষয়ক বিশেষ দূত জন কেরি।
জলবায়ু বিষয়ক এই সামিটের আগে হঠাৎ করে বাংলাদেশে বায়ুমণ্ডলে মিথেনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার গবেষণা নিয়ে তাই প্রশ্ন তুলেছেন আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার। তিনি বলেন, ‘যখন জন কেরি জলবায়ু সংক্রান্ত একটা কনফারেন্সে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানাতে এলেন, তখনই গবেষণাটি প্রকাশ পেল।
এখানে অন্য কিছুর গন্ধ আমরা দেখছি। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহের একটি। সেই জায়গা থেকে আমরা উন্নত দেশসমূহের কাছে ক্ষতিপূরণ কিছু ডিমান্ড করি। কিন্তু তারা এটা দিতে রাজি হচ্ছে না। এখন যেহেতু মিথেন তৈরিতে বাংলাদেশের ভূমিকার কথা উঠে আসছে, তখন তারা ক্ষতিপূরণ আরও দিতে চাইবে না।’
আমাদের মতো সমুদ্রতীরবর্তী দেশের জন্য যা অনিবার্য অভিশাপ। ক্লাইমেট চেঞ্জের ফলে গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর মাধ্যমে এভাবেই আমাদের সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়ার ভয়াবহ ঝুঁকিতে আছে।