বায়ুদূষণে হুমকির মুখে মানুষ ও জীববৈচিত্র
মো. মিকাইল আহমেদ এবং মায়া ভুইঁয়া
চারপাশের পরিবেশ মানুষ প্রতিনিয়ত দূষণ করেই চলেছে। এক মুহুর্ত বিরাম নেই। কল-কারখানার বর্জ্য, গাড়ির ধোঁয়া, ইটের ভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়া, যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনার স্তুপ, ডাইং, স্পিনিং মিলের কেমিক্যাল মিশ্রিত দূষিত পানি, ফসলের ক্ষেতে কীটনাশকের ব্যবহার পরিবেশকে করে তুলেছে মানুষ, জীবজন্তু ও জীববৈচিত্রের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরুপ।
আর এর সাথে যোগ হয়েছে বায়ূ দূষণের কালো থাবা। বায়ূ দূষণে শহর ও নগর বাসী একরকম বিপর্যস্তই। জনজীবন অতিষ্ঠ। একটু দম ফেলার ফুসরত নেই কোথাও।
মানুষ, বাস্তুসংস্থান কিংবা জীববৈচিত্র্যের জন্য বিপদজনক এই বায়ুদূষণের জন্য কিন্তু প্রকৃতিতে বিচরণশীল কোন পোকামাকড়, গহীন জঙ্গলের কোন অবলা প্রাণী কিংবা মাটির নিচে গর্তে বাস করা কোন সর্প দায়ী নয়।
দুঃখজনক হলেও সত্য স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, আশরাফুল মাখলুকাত অর্থাৎ ‘মানুষ’ ই বায়ুদূষণের জন্য পুরোপুরি দায়ী। মানুষের সীমাহীন উচ্চাভিলাষ, অপরিকল্পিত নগরায়ন, আধুনিক শিল্পসভ্যতা মানুষকে বায়ুদূষণ তথা পরিবেশ দূষণের দিকে ধাবিত করছে। মানুষের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না পৃথিবীর ফুসফুস খ্যাত মহাবন আমাজনও।
আমাজনকে নির্বিচারে ধ্বংস করেই চলেছে প্রতিনিয়ত। অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীবাসীর জন্য প্রয়োজনীয় বনাঞ্চল খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সে শঙ্কাও একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। শিল্পায়ন, নগরায়ন আর আধুনিকায়নের নামে পরিবেশকে একরকম গলাটিপেই হত্যা করা হচ্ছে বলা যায়।
বায়ুদূষণে শুধু জীববৈচিত্রই নয়, মানব অস্তিত্বও হুমকির সম্মুখীন। পৃথিবীতে মানুষের দীর্ঘস্থায়ী অস্তিত্বের জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশের সংরক্ষন অতীব জরুরি।
পৃথিবীতে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের যোগান দিতে অনেক কৃষক প্রাকৃতিক পরিবেশবান্ধব পদ্ধতির বদলে ক্ষতিকর রাসায়নিকের আশ্রয় নিচ্ছে।
পরোক্ষভাবে ছড়িয়ে পড়া রাসায়নিকের কুপ্রভাবে গাছপালার অনেক প্রজাতি ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এতে অল্প সময়ে অধিক ফলন নিশ্চিত হলেও মানবদেহ পড়ছে হুমকির মুখে।
জটিল সব রোগজীবাণু বাসা বাঁধছে শরীরে। এতে লাভের চেয়ে বরং ক্ষতির পরিমাণই বেশি। এখানেই শেষ নয়। ফসলের ক্ষেতের ক্ষতিকর রাসায়নিকের কুপ্রভাব গিয়ে পড়ছে আশপাশের পুকুর, খাল-বিল, নদ-নদী, জলাশয় এমনকি সাগরেও। এতে মৎস উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। সামুদ্রিক জীববৈচিত্র নষ্ট হচ্ছে। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সামুদ্রিক প্রবালও।
রাসায়নিক পদার্থের বৃদ্ধির ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে এবং এতে, গাছপালা, মানুষ, সমগ্র প্রাণীকুলের স্বাভাবিক জীবন-যাপন ব্যহত হচ্ছে। পরিবেশ দূষণের মধ্যে অন্যতম একটি হলো বায়ু দূষণ।
বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর মতো বাংলাদেশও বায়ু দূষনের করাল গ্রাসে আক্রান্ত। বিশ্বের সব চাইতে দূষিত শহরের নামের তালিকায় প্রথমে রয়েছে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি এবং দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা।
বায়ু দূষণ কেবল রাজধানী ঢাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। ঢাকার বাইরেও দেশের বিভিন্ন শহর, নগর, বন্দর এখন বায়ু দূষণের কবলে। শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে দূষণের পরিমান তুলনামূলক কম থাকার কথা থাকলেও এখন দেখা যাচ্ছে এর চিত্র পুরোটাই উল্টো।
দেশের আনাচে,কানাচে সর্বত্রই লেগেছে শিল্পায়নের ছোঁয়া। এতে করে বায়ুদূষণ ছড়িয়ে পড়ছে সমগ্র দেশব্যাপী। আর এর কুফল ভোগ করছে সবাই।
বিশেষ করে এই শীতের মৌসুমে আমাদের দেশে বায়ু দূষনের ভয়াবহতা তীব্র আকার ধারন করে। দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়নের ক্রমবিকাশের ফলে দেশে নতুন নতুন কল-কারখানা স্থাপিত হচ্ছে এবং এগুলোতে ব্যাপকহারে ব্যবহার করা হচ্ছে রাসায়নিক পদার্থ।
কেউ গ্যাস পুড়িয়ে পরিবেশের বিনাশ করছে আবার কেউবা কয়লা পুড়িয়ে করছে বায়ুদূষণ। একথাও অনস্বীকার্য যে আধুনিক সভ্যতার প্রয়োজনে ও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার নানাবিধ চাহিদা মেটানোয় শিল্পায়ন ও নগরায়নের কোন বিকল্প নেই।
দিন দিন মানুষের সংখ্যা অধিক হারে বৃদ্ধির ফলে আবাদী জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। ফলে একরকম বাধ্য হয়েই অল্প জমিতে অধিক ফলনের দিকে ঝুঁকছে কৃষকেরা।
অন্যদিকে জীবাশ্ম জ্বালানির দহন ও শিল্প কারখানায় নির্গত ধোঁয়া প্রচুর পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন ও ওজন নির্গত করে, যা গ্রিনহাউস গ্যাস নামেও পরিচিত৷ এই ক্ষতিকর ধোঁয়া একদিকে যেমন বায়ুদূষনের জন্য দায়ী, অন্যদিকে পরিবেশ দূষনের জন্যও।
এসব গ্যাস সূর্য থেকে আসা তাপ ধরে রাখে। আবার পৃথিবী তাপ বিকিরন করে যে ঠান্ডা হবে তাতেও বাধা দেয় এই গ্রিন হাউজ গ্যাস।
বায়ুদূষন এর ফলে জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। আবার পরিবেশ ও সম্পদ বিনষ্ট হয়৷ বায়ুমন্ডলের ওজন স্তর পাতলা হয়ে যাচ্ছে, যার ফলে সূ্র্যের ক্ষতিকর রশ্মি অনায়াসেই ভূমন্ডলে প্রবেশ করতে পারবে। পরবর্তীতে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে জলবায়ুর উপর এবং তা বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তেনেরও অন্যতম কারন।
বায়ুদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন যেন একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। অতিসত্ত্বর এই বায়ুদূষণ রোধ করতে না পারলে দেশ তথা পুরো পৃথিবী হুমকির মুখে পড়বে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জীববৈচিত্রের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণি, গাছপালা, নদ-নদী ও সামুদ্রিক মাছ, জলজ উদ্ভিদ বিলুপ্ত হয়েই গেছে ইতোমধ্যে।
বর্তমান বিশ্ব উষ্ণায়নের যুগে পরিবেশ রক্ষায় কাজ করা ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করার মন মানসিকতা থাকা উচিত। কিন্তু বেশিরভাগ ব্যক্তি ও সংস্থা তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি, আমাদের লক্ষ্য বাস্তবায়নের সীমাবদ্ধতা গুলো কি?
আমরা সাধারণত মনে করি যে সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক বিষয়গুলো আমাদের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা। প্রকৃতপক্ষে, বর্তমান বিশ্বের পরিবেশ বিপর্যয় এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বায়ু দূষনের মাত্রা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রধান অন্তরায়।
বায়ুদূষণের ফলে বৃদ্ধ ও শিশুরা শ্বাস কষ্ট সহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভুগছে। যেমন এলার্জি, হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস, উচ্চ-রক্তচাপ, মাথা ব্যথা, ফুসফুসে ক্যান্সার ইত্যাদি মারাত্নক রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। যার ফলে তাদের দৈনন্দিন স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যহত হচ্ছে। এসকল কারণে তারা অর্থনৈতিক ভাবেও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
নুন আনতে পান্তা ফুরোয় যাদের, তারা খাদ্যের চাহিদা পুরণ করবে নাকি স্বাস্থ্যসেবা গ্রহন করবে? মোটকথা বায়ুদূষণ বাড়তে থাকলে সে স্থানটি মানুষ এর বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে।। বায়ুদূষনের ফলে মানব স্বাস্থ্য ও পরিবেশের মারাত্নক ক্ষতি হয়।
তাই বায়ুদূষণ রোধে আমাদের সকলের সম্মিলিত ভাবে এগিয়ে আসতে হবে। শিল্প কারখানা, ইটের ভাটায় যাতে দূষণকারী পদার্থ বের না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। বেশি করে বৃক্ষ রোপণ কর্মসূচি চালাতে হবে।
জাতীয়ভাবে বনায়ন বৃদ্ধিতে সরকারের উচিত উপযুক্ত পরিকল্পনা গ্রহণ, বাস্তবায়ন ও প্রয়োজনীয় বনাঞ্চল তৈরি করা ও সরকারি ভাবে বৃক্ষরোপন কর্মসূচি পরিচালনা করা। বায়ুদূষন রোধে আইন এর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করাও জরুরি।
লেখক পরিচিতি:
মো. মিকাইল আহমেদ, শিক্ষার্থী, আইসিএমএবি, ঢাকা
মায়া ভুইঁয়া, শিক্ষার্থী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ।