বাংলাদেশের পরিবেশ সুরক্ষা এবং উন্নয়ন ব্যবস্থাপনায় ধীরগতি
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ভূচিত্র প্রকৃতিজুড়ে খেলা করে অপার সৌন্দর্যের এক মুগ্ধবিস্ময়। জলাভূমি, হাওড়-বাঁওড়, বিল-ঝিল ভূমি এবং জলের মধ্যে জীবগুলোকে এমনভাবে সংযুক্ত করে যা প্রাকৃতিক ভাবে তাদের সেখানে সহাবস্থান করতে দেয়।
দেশের হাওড় অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান নিম্ন এবং অসমতল এর বিস্তীর্ন এলাকাজুড়ে শিরা-উপশিরার ন্যায় পেঁচিয়ে আছে অনেক নদ-নদী ও খাল-বিল। বর্ষাকালে গ্রামগুলিকে মনে হয় ভাসমান দ্বীপ, পানির উপর টলমল করে সাগরের ন্যায় বিশাল জলরাশি, দৃষ্টি ছুটে যায় দূর থেকে বহুদূরে।
শুকনো মৌসুমে ধু-ধু মাঠ কৃষকের কলকাকলীতে মুখরিত হয় দেশের হাওরাঞ্চল। সাগরসদৃশ পানির বা জলের বিস্তৃত প্রান্তর হলো হাওড়। উচ্চারণ বিবর্তনে সাগর থেকে সায়র ও সায়র থেকে হাওড় শব্দের উৎপত্তি হয়েছে বলে বোদ্ধামহল মনে করেন। মাছ আর ধান এ দুয়ে পরিচিত বাংলাদেশের হাওড় যা বিদেশে জলাভূমি বলে খ্যাত।
এমনিতেই পানি ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ এখনো অনেকটা প্রকৃতিনির্ভর। দেশে কৃষির উন্নতির জন্য সেচ পদ্ধতির উপর নির্ভরতার কারণে কিছুটা হলেও আলোচনায় রয়েছে পানি।
হাওড়াঞ্চল গ্রীষ্মকালে সাধারণত বিশাল মাঠের মতো আর বর্ষায় তা জলে ভরপুর। হাওড়াঞ্চল বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি জেলার ২৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে গঠিত।
বাংলাদেশ হাওড় ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডের এক জরিপের তথ্য সূত্র অনুযায়ী মোট হাওরের সংখ্যা ৪১৪টি। হাওড় এলাকার উন্নয়নে ২৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি দেড় শতাধিক প্রকল্প সংবলিত একটি ‘হাওড় মহাপরিকল্পনা’ গ্রহণ করেছে সরকার।
ঐতিহাসিকভাবে হাওড়াঞ্চল নানাহ সমস্যায় জর্জরিত। পরিবেশ ও প্রতিবেশের তোয়াক্কা না করে ইজারা নেয়া এ জলমহালগুলির ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের হাতে।
স্থানীয় ভূমিহীন, গরিব কৃষক মৎসজীবীদের জীবন ও জীবিকা এখনো বিপন্ন। অনেক হাওড় শুকিয়ে চাষের জমিতে পরিণত হচ্ছে। আবার কখনো কখনো আকস্মিকভাবে উজান হতে আসা পানির তোড়ে হাজার হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান পানিতে তলিয়ে যায়।
পানি ব্যবস্থাপনার গভীর সংকটে বাংলাদেশ। বিশ্ব পানি দিবস-২০২২ উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে যে কোন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বৃষ্টি ও বন্যার পানি সংরক্ষণের পাশাপাশি জলাধার নির্মাণ ও দুটি বিষয় মনে রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।
বাসস জানায় প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় আয়োজিত ৪ এপ্রিল, নগরীর গ্রিন রোডের পানি ভবনের মূল ভার্চুয়ালি যোগ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদেরকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং ভূগর্ভে জলাধার নির্মাণের ওপর বিশেষ নজর দিতে হবে।
এছাড়া প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট সকলকে খাল, বিল, হাওড় ও বাঁওড়ের সাথে নদীর সংযোগবিন্দু সমূহ খুলে দেয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন তা না হলে নদীর নাব্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি এ সকল বিষয় বিবেচনায় নিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
শেখ হাসিনা নদী খননের সময় নাব্যতা সৃষ্টির পাশাপাশি অতিরিক্ত পানি কিংবা বন্যার পানি সংরক্ষণে বাফার জোন তৈরির ওপরও গুরুত্বারোপ করে বলেন, এ পানি শীতকালে চাষাবাসে ব্যবহার করা যেতে পারে।
তিনি বলেন, বন্যার সঙ্গে কিভাবে বাঁচতে হয়, সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয় সে সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে। কারণ বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ। প্রধানমন্ত্রী সড়ক কিংবা বেড়িবাঁধ নির্মাণের প্রকল্প নেয়ার সময়ে গাছের চারা লাগানোরও নির্দেশ দেন কারণ এ পদক্ষেপ ভূমিধস থেকে রক্ষায় সহায়ক হবে।
তিনি সবাইকে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমানোরও নির্দেশ দেন। কারণ, ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার ঘন ঘন ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে। আর বাংলাদেশকে ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।
উন্নত দেশগুলোতে জলাভূমি ব্যবস্থাপনা অনেক এগিয়ে। যেমন পরিবেশ কানাডা ১৯৮৬-৮৭ সালে জলাভূমি ইস্যুতে ব্যবস্থাপনা সমস্যার উপর একটি জাতীয় বিবৃতি এবং তথ্য পত্র তৈরি করেছিল।
জলাভূমি নীতির জন্য পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ বিষয়ে সারাদেশের মন্ত্রীদের অবহিত করা হয়েছিলো। গুরুত্বপূর্ণ ভূমি ব্যবহার সমস্যার সমাধানে “এ ফ্রেমওয়ার্ক ফর ওয়েটল্যান্ডস পলিসি” তৈরি এবং বাস্তবায়ন করা হয়।
মোদ্দাকথা, ১৯৮৭ সালে গৃহীত নীতি জলাভূমি সংরক্ষণকে একটি গুরুত্বপূর্ণ জল সম্পদ সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। দীর্ঘ সময় ধরে কানাডা রামসার কনভেনশনের একটি স্বাক্ষরকারী দেশ, একটি আন্তর্জাতিক গুরুত্বের জলাভূমি সংরক্ষণের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধকারী আন্তর্জাতিক চুক্তি।
একটি প্রধান কনভেনশনের অধীনে বাধ্যবাধকতা হলো নীতির বাস্তবায়ন, ১৯৮৭ সালে কানাডা দ্বারা প্রস্তাবিত জলাভূমির বিজ্ঞ ব্যবহার।
কানাডিয়ান জলাভূমির সমন্বয়ের জন্য জনসাধারণের সমর্থন, পুনরুদ্ধারের জন্য পদক্ষেপ, আমদানিকৃত জলাভূমির সুরক্ষার জন্য একটি সমবায়, জাতীয় পদ্ধতির মাধ্যমে পরবর্তীকালে, ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে সবুজ পরিকল্পনার মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট অঙ্গীকারকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল।
পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান সুনামগঞ্জের একটি ফসল রক্ষা বাঁধ পরিদর্শনকালে বলেন, আবার বৃষ্টি হবে। তাই ফসল রক্ষায় বাঁধে তদারকি বাড়াতে হবে। ধান পাকলেই কাটতে হবে।
পাকা ধান কোনোভাবেই জমিতে রাখা যাবে না। হাওড়ের ফসল রক্ষায় সবাই মাঠে আছেন জানিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, গত কয়েক দিন সুনামগঞ্জের কৃষকদের জন্য বিপজ্জনক ছিল।
প্রথম ধাক্কা সামলানো গেছে। এ ধাক্কায় অনেক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সরকার এসব কৃষকের পাশে দাঁড়াবে। ইতিমধ্যে সরকারি সহায়তা প্রশাসনের কাছে পৌঁছেছে। এই সহায়তা দ্রুত প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের হাতে পৌঁছাতে হবে।
হাওড়ে স্থায়ী বাঁধ দেওয়া সম্ভব নয় উল্লেখ করে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, আমরা হাওড়ের ফসল রক্ষার জন্য আবার বাঁধ দেব। এটা দিতেই হবে। হাওরে স্থায়ী বাঁধ দেওয়া সম্ভব নয়। আমরা বাঁধ দিই দম ফেলার জন্য—যাতে পাহাড়ি ঢল বা অকাল বন্যা এলে ফসল এক সপ্তাহের জন্য আটকে রাখা যায়।
প্রয়োজন হাওড়াঞ্চল নিয়ে বাংলাদেশে একটি ব্যাপক কৌশলগত পরিকল্পনা তৈরি করা, প্রয়োজন জল-দক্ষতা নীতির সাথে সমন্বয় করে ও ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনার সহায়তাকে অন্তর্ভুক্ত করে অপার সম্ভাবনার দ্বারকে কানাডার মতো উম্মোচন করা।
বাংলাদেশে এক সপ্তাহের উপরে হাওড়াঞ্চলের পাহাড়ি ঢলে ঝুঁকিতে পড়া কৃষকের কষ্টের ফসল রক্ষায় স্থানীয় লোকজন ও বিশেষ করে কৃষকেরা স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে বিভিন্ন বাঁধের শতাধিক স্থানে সংস্কার কাজ করছেন যা চলছে এখনো।
এসব বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় কৃষককুল মনে করেন হাওড়াঞ্চলের সমস্যা ও সংকট এক শ্রেণীর দরিদ্র মানুষের কষ্টের কারণ হলেও আরেক শ্রেণীর মানুষ এর থেকে লাভবান।
বাংলাদেশে হাওড়-বাঁওড়, বিল-ঝিল ও পরিবেশ সুরক্ষায় বর্তমান সরকার আগ্রহী। বিশ্বের মানুষের মুখে মুখে বাংলাদেশের উন্নয়নের গল্প এতদসত্ত্বেও বাংলাদেশকে বদলে দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন অধরা থেকে যাবে যদি না দুর্নীতিমুক্ত ও ক্ষিপ্রগতির ব্যবস্থাপনার অধীন এসব উন্নয়ন কাজগুলোকে না নেওয়া যায়।