বন্ধ করা যাচ্ছে না বনভূমি উজাড়
নানা আলোচনা, উদ্যোগ, পরিকল্পনার পরও বনভূমি উজাড় কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। বনের উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করে একের পর এক উন্নয়ন কাজ করা হচ্ছে। অনেক বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কার মধ্যেই এগুলো করা হচ্ছে।
সম্প্রতি লাঠিটিলার মতো উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যপূর্ণ সংরক্ষিত বনে সাফারি পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে সরকার। পরিবেশ মন্ত্রণালয় বলছে, বন রক্ষার জন্যই এই পার্ক করা হচ্ছে। আর এই পরিকল্পনার বিপক্ষে পরিবেশকর্মীরা।
তারা বলছে, লাঠিটিলা একটি সংরক্ষিত বনভূমি। এখানে সাফারি পার্ক নয়, কোনও ধরনের স্থাপনা নির্মাণেরই সুযোগ নেই। এ ধরনের অভিযোগ শুধু লাঠিটিলায় নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বনভূমি এবং কৃষি জমি ধ্বংসের অনেক উদাহরণ রয়েছে। পরিবেশ-প্রতিবেশ নষ্ট করে নানা স্থাপনা তৈরি অভিযোগ অনেক দিনের।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, পার্ক করা হলে বনের উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হবে। অনেক বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী হারিয়ে যাবে। সাফারি পার্ককে কেন্দ্র করে আশপাশে অনেক ধরনের স্থাপনা গড়ে উঠবে। মানুষের আনাগোনো বাড়বে। বন্য প্রাণীর প্রজননসহ বাসস্থান মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বন বিভাগ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের অন্যতম ক্রান্তীয় চিরসবুজ ও জীববৈচিত্র্যপূর্ণ বনভূমি হচ্ছে লাঠিটিলা। মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নে অবস্থিত এই বনভূমির আয়তন ৫ হাজার ৬৩১ একর।
এই বনে বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীগুলোর মধ্যে হাতি, উল্লুক, মায়া হরিণ, উল্টোলেজি বানর, আসামি বানর, মুখপোড়া হনুমানসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্লভ পাখির বাস।
বন বিভাগ লাঠিটিলায় ৯৮০ কোটি টাকার সম্ভাব্য ব্যয় ধরে সাফারি পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। সাফারি পার্কে বছরে ৮ থেকে ১০ লাখ দর্শনার্থী আসবেন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, শুধু লাঠিটিলায় নয়, রাতারগুল, লাউয়াছড়া, ডুলাহাজরা, সাতছড়িতে সরকারি স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। সংরক্ষিত বন সংরক্ষণের জন্য কোনও স্থাপনার প্রয়োজন হয় না।
সেটাকে প্রাকৃতিকভাবেই থাকতে দেওয়া দরকার। কিছু করার দরকার পড়ে না। মানুষের আগাগোনা বাড়লে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিই হয়।
আমরা শুনেছি, দেশের ১ লাখ ৬৫ হাজার একর বনের জমি সরকারের নানা উন্নয়ন কাজের জন্য দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বন রক্ষায় সবার আগে দরকার সরকারের আন্তরিকতা, যা আমরা একেবারেই দেখতে পাই না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, লাঠিটিলায় সাফারি পার্ক করা হচ্ছে বনকে সংরক্ষণের জন্যই। এই বনে এখন মানুষের এমনিই আনাগোনা বেড়েছে। আমরা পার্ক করলে মানুষের অবাধ যাতায়াত কমে আসবে। প্রাণীদের আমরা সুরক্ষা দিতে পারবো।
গত রোজার ঈদে প্রচুর পর্যটক ঘুরতে যান সেখানে লাউয়াছড়ায়। সংরক্ষিত বনে পর্যটকদের এই ভিড় সেখানকার বন্যপ্রাণী তথা জীববৈচিত্র্যের জন্য বিরাট হুমকি বলে মনে করছেন পরিবেশবাদীরা।
পাশাপাশি তাদের ফেলে আসা বিভিন্ন কোমল পানীয়’র ক্যান ও প্লাস্টিকের বোতল পলিব্যাগসহ বিভিন্ন বর্জ্য বনের পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক। তাই লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে প্রবেশ সীমিত করার দাবি তাদের।
এদিকে বণ্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ৪৬০ প্রজাতির জীববৈচিত্র্য রয়েছে।
২৪৬ প্রজাতির পাখি, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৪ প্রজাতির উভচর প্রাণীর বিচরণ এই বনে। এছাড়া এই ক’বছরে বন বিভাগ ১৬৭ প্রজাতির বন্যপ্রাণী এই বনে অবমুক্ত করেছে বলে তারা জানান। ফলে বনের ক্ষতি হচ্ছে না, বরং জীববৈচিত্র্য রক্ষায় তারা কাজ করছেন।
এ ধরনের অভিযোগ শুধু লাঠিটিলায় বা লাউয়াছড়ায় নয়, বনভূমি আছে এমন সব এলাকায় বন উজাড়ের ঘটনা ঘটছে বলেই এলাকাবাসীর অভিযোগ।
বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে দেশের পার্বত্য তিন জেলায় বনভূমি নষ্ট করার অভিযোগ রয়েছে। গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ (জিএফও) এর হিসাব অনুযায়ী, ২০০২ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে দেশে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ প্রাকৃতিক বন উজাড় হয়েছে।
এর মধ্যে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে হার ৯ শতাংশের বেশি। দেশের মোট বনভূমির মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতেই রয়েছে ৪০ শতাংশ ।
পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, পার্বত্য এলাকায় গাছ কেটে, পাহাড় কেটে নানা পর্যটন স্পট বানানো হচ্ছে, পর্যটকদের থাকার জন্য বানানো হচ্ছে আধুনিক হোটেল, রিসোর্ট।
আর পরিবেশ মন্ত্রণালয় অভিযানের কথা বললেও তা এত অপ্রতুল যে চোখেই পড়ে না কারও। বরং সরকারি উদ্যোগে বন ধ্বংস এখন সবারই জানা।