পৃথিবীব্যাপী আজ ব্যাপক পরিমানে ব্যবহৃত হচ্ছে নানান আকারের প্লাস্টিকের পদার্থ।প্লাস্টিক পণ্য ওজনে হালকা, বহনে সহজ, প্রয়োজনে সহজেই যত্রতত্র নিয়ে ব্যবহার করা যায়, দামেও সস্তা।রান্নাঘর থেকে শুরু করে দিনের প্রায় প্রত্যেকটি কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে প্লাস্টিক পণ্য।মনে হয় এ যেন প্লাস্টিকের সমাহার।
পৃথিবীতে প্রতি বছর ত্রিশ কোটি মেট্রিক টনেরও বেশি প্লাস্টিক সামগ্রী তৈরী হচ্ছে। এক হিসেবে দেখো গেছে, গত এক দশকে বিশ্বে যত প্লাস্টিক দ্রব্য তৈরি হয়েছে, তার আগের একশো বছরেও তা হয়নি।বিপ্রল পরিমানে এই প্লাস্টিক পণ্য ধ্বংস করছে মানবস্বাস্থ্য,স্থলভাগের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য এবং জলভাগের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।
প্লাস্টিক মূলত খনিজ তেল, অর্থাৎ পেট্রোলিয়াম থেকে প্রস্তুত করা একটি বস্তু। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোর মাটির নিচে প্রকান্ড সব খনিজ তেলের ভান্ডার আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকেই প্লাস্টিকের তৈরি সামগ্রী বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে।
প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারের পর বর্জ্য হিসাবে ছড়িয়ে আাছে কৃষিক্ষেত্রে, রাস্তার পাশে, নালা-নর্দমায়, খাল-বিলে,নদ-নদীতে,সাগরে-মহাসাগরে। এমনকি, হিমালয় পর্বতের সর্বোচ্চ চূড়া এভারেস্ট শৃঙ্গেও। প্লাস্টিক কিন্তু পচে না বা সহজে নষ্ট হয় না। শত শত বছর, এমনকি হাজার বছরেরও বেশি সময় অবিকৃত থেকে যায়। আবার প্লাস্টিক পোড়ালে প্লাস্টিক থেকে বিষাক্ত কিছু গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে । এইসব গ্যাসের মধ্যে আছে ডাই-অক্সিন, হাইড্রোজেন ক্লোরাইড ইত্যাদি। এইসব গ্যাস ক্যানসার রোগ সৃষ্টিতে বা এই রোগের বৃদ্ধিতে সহায়কের কাজ করে। আবার যেসব দ্রব্যের একক থেকে বিভিন্ন প্রকারের প্লাস্টিক দ্রব্য তৈরি হয়, সেইসব দ্রব্যও ক্যানসার রোগ সৃষ্টিতে বা ওই রোগ বৃদ্ধিতে সহায়কের কাজ করে।
সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখন যে হারে প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রের পানিতে ফেলা হচ্ছে, এই হার বজায় থাকলে আগামী পঁচিশ তিরিশ বছরে তার সংখ্যা সমুদ্রের জলজ প্রাণীর সংখ্যা থেকে বেশি হয়ে যাবে।স্থলভাগেও প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমাণ দিন দিন বৃৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন, বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ৮০ থেকে ৯০ লক্ষ টন প্লাস্টিকের অন্তিম আশ্রয় সমুদ্র। আর এর বড় অংশই সমুদ্রে আসে দূষিত নদীগুলোর মাধ্যমে। সমুদ্রে এসে পৌঁছানো প্লাস্টিকের দুই-তৃতীয়াংশেই বয়ে নিয়ে আসে বিশ্বের ২০টি সর্বাধিক দূষিত নদী, যার মধ্যে চীনের ইয়াংসি, ইন্দোনেশিয়ার প্যাসিগ আর আমাদের পদ্মা সমেত ১৫টি এশিয়ার। এই বিপুল পরিমাণ অক্ষয়, অভঙ্গুর প্লাস্টিকের বড়, ছোট এমনকি আনুবীক্ষণিক টুকরোর দূষণে একাধিক বিপন্ন প্রজাতিসহ প্রায় ২২৭০টি সামুদ্রিক প্রজাতি সরাসারি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সম্প্রতি ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী এথেন্সকেন্দ্রিক পেলাগোজ কেটাসিয়ান রিসার্চ ইন্সটিটিউটের গবেষকরা গ্রিসের সমুদ্রে স্পার্ম হোয়েল প্রজাতির মৃত তিমিরের প্রায় প্রত্যেকের পাকস্থলীতে প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিক পেয়েছেন। গত জানুয়রিতেও একই ভাবে উত্তর সাগরের তীরভূমিতে এসে মারা যাওয়া ২৯টি তিমির সুরতহাল করতে গিয়ে তাদের পেটেও পাওয়া গিয়েছিল দলা পাকানো বড় বড় প্লাস্টিকের টুকরো। যেসব সামুদ্রিক মাছ আমরা খাই, তার মাধ্যমে আমাদের দেহেও সবার অলক্ষ্যে প্রতিদিন ঢুকে পড়ছে আণবীক্ষণিক প্লাস্টিক তন্ত।
গত বছর সেপ্টেম্বরে আমেরিকার মিনসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক কাম্পালা, দিল্লি, জাকার্তা, ইউরোপের সাতটি ও মার্কিন মুলুকের একাধিক শহর থেকে মোট ১২৯টি কলের পানির নমুনা পরীক্ষা করে ৮৩ শতাংশ নমুনাতেই প্লাস্টিকের অতিক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক তন্তর অস্তিত্বের প্রমাণ পান।
শুধু পানিভাগেই নয়, স্থলভাগেও প্লাস্টিক নানাভাবে দূষণ ছড়িয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। এই দূষণের ফলে মানুষসহ স্থলজ সকল প্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কৃষিক্ষেত্রে প্লাস্টিকের উপস্থিতি কৃষিজাত শস্যের ফলনে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। বর্ষার মরশুমে শহরাঞ্চলের নালা-নর্দমায় জমে থাকা প্লাস্টিক রাস্তায় পানি জমার কারণ হয়ে উঠছে। বর্ষব্যাপী নালা-নর্দমায়, রাস্তাঘাটে, বাড়ির আনাচে-কানাচে ফেলে রাখা প্লাস্টিকের গায়ে আটকে থাকা পানিতে মশার বংশবৃদ্ধিতে সাহায্য করছে। বায়ুমন্ডলেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা ভীষণভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এইসব কণা শ্বাসক্রিয়ার সাথে জীবদেহে প্রবেশ করে জীবদেহের ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে।
প্লাস্টিকের সর্বব্যাপী আগ্রাসনে নানাভাবে দূষিত হচ্ছে আমাদের স্থলভাগ ও জলভাগ।পরিবেশকে বাঁচাতে হলে,পরিবেশের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হলে খুব দ্রুত এর বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেওয়া ও বাস্তবায়ন করা একান্ত জরুরি।নতুবা এক পর্যায়ে পরিবেশের বাস্তুসংস্থান ভেঙ্গে পড়বে।