প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর বাইক্কা বিল
কোনো এক কালে কোনো আয়োজন ছিল না, হইচই ছিল না। সেদিনও এমনই একটি হাওর ছিল। হাওরের বুক ভরা ছিল শাপলা-শালুক আর পদ্মের দলে। ছিল ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি।
সেদিনও হাওরের আকাশ রঙিন হয়েছে মালার মতো উড়ে যাওয়া পাখির পালকে। পাখির ডানার শব্দে হিমরাত টুকরা টুকরা হয়ে ঝরে পড়েছে ঘাস ও শিশিরে।
একদিন কী করে যেন বদলে যায় সব। মৌলভীবাজারের হাইল হাওরটির এমন পাখিমগ্নতার ঘোর ভেঙে যায়। আগের মতো শাপলা-শালুক, পদ্মপাতা আর ভাসে না জলে। পাখি পথ বদল করে অন্য কোথাও উড়ে যায়। পাখির ডানার উল্লাস নেই, কিচিরমিচির নেই। বুকভরা এমন শূন্যতায় মন ভার হয়ে থাকে হাওর-প্রকৃতির।
হাওরের বিল শুকিয়ে মাছ ধরা, ইচ্ছেমতো পাখি শিকার, নির্বিচার জলজ উদ্ভিদ আহরণ—এসব কারণে পাখি ও মাছের সংখ্যা কমে গিয়েছিল তখন। তাই বলে শ্রীমঙ্গল ও সদর উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত হাইল হাওরে, যেখানে ১৭৫ প্রজাতির পাখি দেখা গেছে, সেই হাওর তো এমন ম্লান–নিষ্প্রাণ পাখিবিরহে থাকতে পারে না।
এ রকম সময়েই আবার হাওরের জলে হারিয়ে যাওয়া মাছ ঘাই তুলবে, ভরে উঠবে জলজ ফুল-ফলে। বদলানো পথ থেকে ফিরে আসবে পাখির ঝাঁক—এমন আকাঙ্ক্ষায় ২০০৩ সালে ভূমি মন্ত্রণালয় প্রায় ২৫০ একর আয়তনের জলাভূমিকে ‘বাইক্কা বিল অভয়াশ্রম’ ঘোষণা করে।
এখানে নিষিদ্ধ করা হয় মাছ ধরা ও জলজ উদ্ভিদ আহরণ। সুফলও মিলতে থাকে। প্রাকৃতিক পরিবেশ পেয়ে বিলুপ্তপ্রায় ও বিপন্ন মাছগুলো হাইল হাওরে ফিরে আসে। ফিরে আসে শাপলা, পদ্ম, মাখনা, সিংরাইসহ নানা রকম জলজ উদ্ভিদ।
মাছ, জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ বাড়ে। বসবাসের নিরাপত্তা ফিরে আসায় যেসব পাখি হাইল হাওর থেকে গতিপথ পাল্টে নিয়েছিল, সেগুলো আবার আসতে থাকে। বাইক্কা বিল পাখিরও অভয়াশ্রম হয়ে ওঠে।
আবার হাওরের বুকজুড়ে শিস কাটে পাখি ওড়ার তরঙ্গ, পাখির রঙে চিত্রময় হয়ে ওঠে বাইক্কা বিলের আকাশ। শুধু শীতেই পরিযায়ী পাখি আসে না, অনেক পরিযায়ী পাখিই বাইক্কা বিলকে স্থায়ী আশ্রয় করেছে। অনেক পাখিই বারো মাস বাইক্কা বিলে সংসার পেতেছে।
সকাল হলেই পাখি হাওরের ঘুম ভাঙাতে থাকে। হাজারো পাখির ওড়াউড়ি, কিচিরমিচির আর ডানায় রোদের ঝিকিমিকি বাইক্কা বিলকে যন্ত্র-কোলাহল থেকে আলাদা করে রাখে। বিলের আকাশজুড়ে কখনো গলার হার হয়ে ঘুরে বেড়ায় পাখি। কখনো ভেজা ঘাসে দল বেঁধে বিশ্রামে বসে। কখনো টলমল করা জলে বুক ডুবিয়ে ভাসতে থাকে।
দুপুরটা ডুবসাঁতারেই কেটে যায় পাখিগুলোর। সন্ধ্যায় লাল সূর্য ডুবতে থাকলে কোথাও যেন ফিরতে চায় সেসব পাখি। বিলের এপাশ থেকে ওপাশে উড়তে থাকে সেসব পাখি। কত জাতের পাখিই না ওই ভিড়ে মিশে থাকে।
সংখ্যায় কখনো বেশি, কখনো কম হলেও অন্তত ৪০ জাতের জলচর পাখির দেখা মিলেছে বাইক্কা বিলে। নভেম্বর থেকেই পাখি আসতে থাকে। ঝড়–বাদল শুরু না হলে থাকে মার্চ মাস অবধি। বছরের প্রায় অর্ধেক সময় পরিযায়ী পাখির ঠিকানা এই বাইক্কা বিল।
এই পাখির সংসারে আসে বালিহাঁস, খয়রা কাস্তে চরা, তিলা লালসা, গেওয়ালা বাটান, পিয়াং হাঁস, পাতি তিলা হাঁস, নীলমাথা হাঁস, উত্তুরে লেঞ্জা হাঁস, গিরিয়া হাঁস, উত্তুরে খুন্তিহাঁস, মরচে রং ভূতিহাঁস, মেটেমাথা টিটি, কালালেজ জৌরালি, বিল বাটান, পাতিসবুজলা, বন বাটান, পাতিচ্যাগা, ছোট ডুবুরি, বড় পানকৌড়ি, ছোট পানকৌড়ি, গয়ার, বাংলা শকুন, এশীয় শামুকখোল, পানমুরগি, পাতিকুট, নিউপিপি, দলপিপি, কালাপাখ ঠেঙ্গি, উদয়ী বাবু বাটান, ছোট নথ জিরিয়া, রাজহাঁস, ওটা, ধুপনি বক, ইগল, ভুবন চিল ইত্যাদি।
প্রায় সারা বছরই বাইক্কা বিলে দেখা মেলে হলদে বক, দেশি কানিবক, গো–বক, ছোট বক, মাঝেলা বগা, লালচে বক, বেগুনি কালেম, বড় বগা, দেশি মেটে হাঁস, সরালি, বালিহাঁস, পানমুরগি। আর হিজলবনে তো আছেই শালিক, ঘুঘু, দোয়েল, চড়ুই, বুলবুলি, দাগি ঘাসপাখি, টুনটুনি, ফিঙেসহ অনেক পাখি।
বাইক্কা বিল দেখভালের সঙ্গে যুক্ত আছে বড়গাঙ্গিনা সম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটি। এই কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিন্নত আলী। হাওরপাড়ের এই মানুষ বলছিলেন সে কথা, হাইল হাওরে প্রচুর পাখি ছিল, প্রচুর পাখি আসত।
তখন গুলি করে পাখি মারা হতো। একটা সময় পাখি আসা কমে যায়। তারপর মাছের অভয়াশ্রম হলো। এরপর মাছও বাড়ল, পাখিও বেড়েছে। হাওরেও ফিরেছে প্রাণপ্রকৃতি।
বাইক্কা বিলের জল-ডাঙায় এখন ফিরে আসা সেই পাখিরই উৎসব-উল্লাস। পৌষের রোদ, কুয়াশা ও জ্যোৎস্নায় এখন সেখানে পাখির সরব–নীরব গান। হাঁসের গায়ের ঘ্রাণ বাতাসের বুকে মিশে থাকে।