প্রাকৃতিক উপকরণ দিয়ে বানানো কারুকার্যময় প্রতিষ্ঠান ‘আনন্দালয়’ ও ‘মেটি স্কুল’
দিনাজপুরের রুদ্রপুর গ্রামটি বিরল উপজেলার ৯ নং মঙ্গলপুর ইউনিয়নের অর্ন্তভূক্ত । এখানে অবস্থিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দীপশিখা নন-ফরমাল এডুকেশন, ট্রেনিং অ্যান্ড রিসার্চ সোসাইটি ফর ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট। এর ভেতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে দ্বিতল একটি ভবন। এতে লেখা আছে ‘দীপশিখা’। মাঠে কচিঁ সবুজ ঘাস। চারপাশে ফুলের সমারোহ ও সুগন্ধে আবেশিত পরিবেশ। পাখির কিচিরমিচিরে অপরূপ পরিবেশ। শীতল আবহাওয়া। নেই কোথাও কোলাহল ।
‘আনন্দালয়’ নামের কমিউনিটি থেরাপি কেন্দ্রটি রয়েছে ঠিক ভবনের পেছনের দিকটায় । রাস্তার দু’ধারে লম্বা লম্বা সুপারির গাছ পেরিয়ে মাটির তৈরি এই ভবনের কাছে গেলে দৃষ্টি আটকে যায়! নিচতলা পুরোপুরি প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য ব্যবহৃত হয়। ঘরের ভেতর মাটির তৈরি গুহা। এতে শিশুরা খেলাধুলা করে আনন্দে মাতে। গুহার ভেতর চলাফেরার জন্য প্রতিবন্ধীদের এক ধরনের ব্যায়াম হয়ে যায়, এটি তাদের প্রতিদিনের চিকিৎসার একটি অংশ। ভবনে আলো-বাতাস সহজে আসা-যাওয়া করতে পারার সুব্যবস্থাও রয়েছে। ঘরগুলো পরিপূর্ন ভাবে পরিবেশবান্ধব এবং প্রতিবন্ধীদের চলাচলের সুবিধার্থে রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা।
দিনাজপুরের আনন্দালয়ের দ্বিতল ভবনে প্রতিবন্ধী ও হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীরা যেন অনায়াসে একটি কক্ষ থেকে অন্য কক্ষটিতে এবং একতলা থেকে দ্বিতীয় তলায় যাতায়াত করতে পারে সেজন্য প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রেখে নকশা সাজানো হয়েছে। আনন্দালয়ের দক্ষিণ দিকে পুকুর এবং পশ্চিম-উত্তর দিকে মেটি স্কুল। এটিও দোতলা। দুটি ভবনই একই আদলে গড়া। এছাড়া পুরো এলাকায় রয়েছে সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, কারিগরি বিভিন্ন প্রশিক্ষণের জন্য আলাদা কক্ষ, অফিস কক্ষ, নামাজ ঘর।
নজরকাড়া স্থাপনা আনন্দালয় এবং মেটি স্কুলের সুবাদে দিনাজপুরের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলটি সুপরিচিত। সামাজিক ও স্থাপত্যিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রান্তিক ও পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর শিক্ষার মান বৃদ্ধি, প্রতিবন্ধী সেবা কার্যক্রম ও কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে দ্বিতল কেন্দ্র দুটিতে।
সম্পূর্ন প্রাকৃতিক উপকরণ যেমন – মাটি, বাঁশ, খড়, দড়ি, বালি, সিমেন্ট, কাঠ ইত্যাদি দিয়ে বানানো আনন্দালয়ের স্থাপত্যশৈলী বৈচিত্র্যময় ও অপূর্ব। এটি নকশা করেছেন বিখ্যাত জার্মান স্থপতি আন্না হেরিঙ্গা। এই নকশাটি করার জন্য সম্প্রতি আন্তর্জাতিক পুরস্কার ওবেল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন তিনি। একই উপকরণ দিয়ে গড়ে তোলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মেটি স্কুলের সুবাদে ২০০৭ সালে তিনি পেয়েছিলেন আগা খান আর্কিটেকচার অ্যাওয়ার্ড।
দিনাজপুরের মেটি স্কুলপ্রাকৃতিক উপকরণে নির্মিত কারুকার্যময় ভবন দুটি দেখতে প্রতিদিন দর্শনার্থীদের ভিড় দেখা যায়। দিনে দিনে দেশি-বিদেশি শিক্ষার্থীসহ পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে। তবে করোনাভাইরাসের কারণে ১০-১৫ মিনিট স্থাপত্যশৈলী দেখার সুযোগ দেওয়া হয় এখন।
ঢাকা থেকে আসা এক অতিথির কথায়, ‘দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জে আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। অনেকদিন থেকেই ইচ্ছে ছিল আনন্দালয় ও মেটি স্কুল দেখবো। সত্যি বলতে মাটির তৈরি ঘর এমন সুন্দর হতে পারে তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হতো না।’
ঢাকা থেকে আসা অন্য আরেক অতিথি বলেন, ‘শুধু মাটির তৈরি ঘরই নয়, এই এলাকার নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশ বেশ উপভোগ্য। এখানে এসে মন জুড়িয়ে গেলো। প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা ও প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে দীপশিখার কার্যক্রম প্রশংসার দাবিদার।’
একজন দর্শনার্থী বলেন, ‘আগে অনেক নাম শুনেছি, তাই পরিবার নিয়ে বেড়াতে এসেছি। মাটির কিংবা বাঁশের স্কুলটির কারুকার্য ও নির্মাণশৈলী অবাক করার মতো।’
দিনাজপুরের আনন্দালয় দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই দৃষ্টিনন্দন ভবন দুটিতে স্বাস্থ্যসেবা, প্রচলিত লেখাপড়া ও কারিগরি শিক্ষায় উপকার পাচ্ছেন সর্বসাধারণ। পরিবেশবান্ধব ও আরামদায়ক আনন্দালয় এবং মেটি স্কুলের কক্ষগুলোতে গরমকালে ঠান্ডা ও শীতকালে গরম অনুভূত হয়।
সহজে যেন ফাটল কিংবা ঘূণে না ধরে, ক্ষয়ে না যায়, ভেঙে না পড়ে ও বৃষ্টিতে নষ্ট না হয় সেভাবেই এগুলো তৈরি হয়েছে। পুরো ভবনের দেয়ালে নির্দিষ্ট আনুপাতিক হারে রয়েছে মাটি, বালি ও সিমেন্ট। নিচতলা ও দোতলার দেওয়াল প্লাস্টারে ব্যবহার করা হয়েছে পামওয়েল ও সাবান।
বিরলের মঙ্গলপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেরাজুল ইসলাম বলেন, ‘২০ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
মেটি স্কুলের মাধ্যমে গ্রামে শিক্ষার মান বৃদ্ধি পেয়েছে। কারিগরি শিক্ষার ফলে অনেকেই শিক্ষিত হয়ে উঠছেন। পাশাপাশি ফিজিওথেরাপি কেন্দ্র গড়ে ওঠায় চিকিৎসার জন্য কাউকে শহরে কিংবা ঢাকায় যেতে হচ্ছে না এবং চিকিৎসা ব্যয়ও সাশ্রয়ী।’
দিনাজপুরের দীপশিখাদীপশিখা প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৭৮ সালে। শুরুতে এর কাজ ছিল প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের ভূমিহীন, প্রান্তিক কৃষক, খেটে খাওয়া ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করা। ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ এনজিও ব্যুরোর নিবন্ধনভুক্ত হয় দীপশিখা।
১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বরে এটি স্বল্প পরিসরে গড়ে তোলে মডার্ন এডুকেশন অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (মেটি) স্কুল। এতে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত স্থানীয় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিশুদের শিক্ষা প্রদান কার্যক্রমের পাশাপাশি নানান ধরণের প্রয়োজনীয় শিক্ষা যেমন- নাচ, গান, অভিনয়, বিতর্ক ও সংস্কৃতি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
সংগঠনটি প্রতিবন্ধীদের জন্য গড়ে তোলে পরিবেশবান্ধব কমিউনিটি থেরাপি কেন্দ্র ‘আনন্দালয়’। ২০১৯ সালের ১৪ নভেম্বর এর যাত্রা শুরু হয়। প্রতিবন্ধী শিশুদের পুনর্বাসন, ক্ষমতায়ন এবং নাগরিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ফিজিওথেরাপি, ব্যায়াম ও শিক্ষা দেওয়া হয় এতে। তিহাত্তর লাখ টাকা ব্যয়ে তৈরি হয়েছে প্রতিবন্ধীদের উপযোগী ও প্রবেশগম্য ভবন। দোতলায় রয়েছে নারীদের জন্য টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট।
দিনাজপুরের আনন্দালয়থেরাপি ও শিক্ষায় আনন্দালয়ের ইমপ্রুভিং দ্য লাইভস অব পিপল উইথ ডিসঅ্যাবিলিটি (আইএলপিডি) নামক প্রকল্পে অর্থায়ন করছে হংকংয়ের দ্বাতব্য প্রতিষ্ঠান কাদেরী চ্যারিটেবল ফাউন্ডেশন।
পল্লী এলাকার অতি দরিদ্র বিশেষ করে ভূমিহীন, দিনমজুর, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর (সমতলের নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী, শিশু-কিশোর-নারী এবং প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী) ৫০০টি পরিবার এই প্রকল্পের অধীন।
প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীদের দৈহিক কার্যক্ষমতা, চলাচলের ক্ষমতা, তাদের বসবাসের পরিবেশগত অবস্থার উন্নয়ন করা, স্কুলে অনুকূল সহায়ক ও একীভূত শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে শিশুদের শিক্ষা অব্যাহত রাখা, জীবিকার সুযোগ ও প্রতিবন্ধী এবং তাদের অভিভাবকদের আয় ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা, প্রতিবন্ধীদের প্রতি কমিউনিটি পর্যায়ের জনগণকে তৎপর করা এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য।
এজন্য ফিজিওথেরাপি সেবা, প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা সহায়তা প্রদান, ইনক্লুসিভ লাইভলিহুড ডেভেলপমেন্ট, সচেতনতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে আনন্দালয়।
দীপশিখার নির্বাহী পরিচালক জগদীশ চন্দ্র রায় বলেন, ‘দীপশিখা মূলত প্রত্যন্ত অঞ্চলের ভূমিহীন, প্রান্তিক চাষি, খেটে খাওয়া ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য গড়ে উঠেছিল।
এসব মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি আমরা। এরই ধারাবাহিকতায় স্থানীয় শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মানোন্নয়নে মেটি স্কুল গড়ে তোলা হয়েছে। গত বছর এই এলাকার প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসা প্রদান ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে আনন্দালয় তৈরি হয়েছে। এছাড়া এখানে সেলাইসহ বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।’
সূত্র – বাংলা ট্রিবিউন