পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব মানুষের: ইসলাম
মানুষকে আল্লাহতায়ালা খলিফা হিসেবে দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন। এ দুনিয়ায় আমরাই আল্লাহর প্রতিনিধি। তাই দুনিয়ার সিস্টেমকে নষ্ট হতে না দেওয়া এর সংরক্ষণ আমাদের উপরেই বর্তায়। সুতরাং পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব মানুষেরই। ইসলাম হচ্ছে, ফিতরাত বা স্বভাবগত বা প্রকৃতির ধর্ম। মহান রাব্বুল আলামিনের সৃষ্টির অন্যতম সেরা মানুষ বেসিক্যালি সামাজিক জীব। মানুষকে ঘিরেই পরিবেশ-প্রকৃতি ও সমাজের সৃষ্টি। তাই পরিবেশ সংরক্ষণ ইসলামে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বৃক্ষ বা গাছ। মানুষ ও পরিবেশের অকৃত্রিম বন্ধু। সবুজ গাছপালার উপরই নির্ভর করে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর টিকে থাকা। জীবের জন্য গাছপালা সালোক-সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খাদ্য প্রস্তুত করে। শুধু খাদ্য তৈরি নয়, সালোক-সংশ্লেষণের সময় তারা কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে ও অক্সিজেন বের করে দেয়।
ফলে বায়ুম-লে অক্সিজেন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ভারসাম্য রক্ষা হয়। হাদিসে রাসুল (সা.) থেকে জানা যায়, একজন লোক যখন অকারণে একটি গাছের ডাল ভাঙে, তখন নবী করিম (সা.) সে লোকটির চুল মৃদুভাবে টান দিয়ে বললেন, ‘তুমি যেমন শরীরে আঘাত বা কেটে গেলে ব্যথা পাও, গাছের পাতা বা ডাল ছিড়লে গাছও তেমন ব্যথা পায়।’
পরিবেশের ভারসাম্যের জন্য গাছ লাগানোর শিক্ষা আমরা মহানবী (সা.) থেকে পাই। তিনি বলেছেন, ‘যদি তুমি মনে করো আগামীকাল কেয়ামত হবে, তবু আজ একটি গাছ লাগাও।’ রাসুল (সা.) বৃক্ষরোপণকে উৎসাহিত করে বলেছেন, ‘বৃক্ষরোপণ সদকায়ে জারিয়া হিসাবে পরিগণিত হবে।’ (বোখারি ও মুসলিম)। রাসুল আরও (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলমান যদি একটি বৃক্ষ বা গাছ রোপণ করে অথবা ক্ষেতখামার করে, অতঃপর তা হতে মানুষ, পাখি বা কোনো প্রাণী ভক্ষণ করে, তা তার জন্য দান বা সদকার সওয়াব হবে।’
পরিবেশ সংরক্ষণে ইসলাম যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, তা মহানবী (সা.)-এর উপরোক্ত হাদিসগুলো থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বলতে গেলে পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যাপারে ইসলামের দিকনির্দেশনা সুস্পষ্ট। কোরআন-হাদিসে পরিবেশ সংরক্ষণকে বিভিন্ন আয়াত ও হাদিসে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ কোরআনে প্রায় ৬০টি আয়াতে পানির কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আকাশম-লী ও পৃথিবীর মুখ বন্ধ ছিল, অতঃপর আমি উভয়কে খুলে দিলাম এবং প্রাণবন্ত সবকিছু আমি (আল্লাহ) পানি থেকে সৃষ্টি করলাম’ (সুরা আল আম্বিয়া : ৩০)। দুনিয়ায় যা কিছু প্রাণ পেয়েছে তা শুধু পানি থেকেই পেয়েছে।
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের জন্য সমুদ্র ও স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে।’ (সুরা রুম : ৪১) আল্লাহ পৃথিবীতে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা জীবজগতের অস্তিত্ব রক্ষায় বৃক্ষ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন : ‘আমি বিস্তৃত করেছি ভূমিকে ও তাতে স্থাপন করেছি পর্বতমালা এবং উৎপন্ন করেছি নয়নাভিরাম বিবিধ উদ্ভিদরাজি। এটি আল্লাহর অনুরাগী বান্দাদের জন্য জ্ঞান ও উপদেশস্বরূপ’ (সুরা কাফ : ৭-৮)।
সুরা আন’আমের ১৪১ নম্বর আয়াতের শেষাংশে তিনি আরও বলেন, ‘আল্লাহ অপচয়কারীদের ভালোবাসেন না’। এই আয়াত আরও গুরুত্ব পেয়েছে, মহানবী তাঁর এক সাহাবিকে সতর্ক করেছিলেন কারণ, ওই সাহাবি গোসলের পর অবশিষ্ট পানি ফেলে দিয়েছিলেন। মহানবী তাকে বলেছিলেন, উদ্ধৃত পানি নদীতে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত, যাতে ভাটির অন্য মানুষের চাহিদা পূরণ হয়। ভাটির মানুষের অধিকার এখানে সুস্পষ্ট।
অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় উজানের মানুষরা বাঁধ দিয়ে নদীর পানির স্বাভাবিক স্রোতকে বাধাগ্রস্ত করে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভাটির মানুষ। পরিবেশ ও ভাটির মানুষের অধিকার রক্ষায় মহানবী সামান্য গোসলের পানির ব্যাপারেও সতর্ক করেছেন।
পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে, মাটি ও পানি। মূলত মাটি থেকেই বিভিন্ন খাদ্যশস্য উৎপাদন করা হয় এবং উৎপাদিত শস্য পানি দ্বারা জীবিত থাকে। এ প্রসঙ্গে কোরআনে এরশাদ হচ্ছে, ‘তাদের জন্য নিদর্শন একটি মৃতভূমি। আমি একে সঞ্জীবিত করি এবং তা থেকে উৎপাদন করি শস্য, তারা তা ভক্ষণ করে। আমি তাতে উৎপাদন করি খেজুর এবং প্রবাহিত করি ঝর্ণাধারা, যাতে তারা ফল খায়।’ (সুরা ইয়াসিন : ৩৩)। সুন্দর ও শৃঙ্খলাপূর্ণ সামাজিক পরিবেশ গঠনে খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, রাস্তা-ঘাট পরিষ্কার থাকা অপরিহার্য। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ঈমানের ৭৩টি শাখার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, রাস্তা থেকে ক্ষতিকারক বস্তু দুরীভূত করা।
তিনি আরও বলেছেন, ‘পবিত্রতা ঈমানের অর্ধাংশ।’ হজরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুল (সা.) পানিতে প্রস্রাব করতে নিষেধ করেছেন। রাসুল (সা.) আরও বলেছেন, ‘তোমরা অভিশাপ পাওয়ার তিনটি কাজ অর্থাৎ পানির ঘাটে, রাস্তার মাঝে এবং বৃক্ষের ছায়াতলে মলত্যাগ থেকে বিরত থাক।’ হাদিসে রাসুল (সা.) থেকে আরও জানা যায়, মৃত শরীরের কোনো অংশ তিনি যত্রতত্র ফেলতেন না, কারণ তা একসময় শুকিয়ে বাতাসের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। যা পুতে না ফেললে তা কোনো প্রাণী বা পাখির দ্বারা ছড়িয়ে পরিবেশ দূষিত করতে পারে। এজন্য রাসুল (সা.) রক্ত বা গোশত মাটিতে পুতে ফেলতেন বা পুতে ফেলার নির্দেশ দিতেন। বায়ুদূষিত হয়ে একজনের রোগ অন্যজনের কাছে স্থানান্তর হয়।
পরিবেশ দূষণ থেকে বাঁচতে হলে পরিচ্ছন্নতা অপরিহার্য। আল্লাহপাক পৃথিবীতে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা জীবজগতের অস্তিত্ব রক্ষায় বৃক্ষ সৃষ্টি করেছেন। এরশাদ হচ্ছে : ‘আমি বিস্তৃত করেছি ভূমিকে ও তাতে স্থাপন করেছি পর্বতমালা এবং উৎপন্ন করেছি নয়নাভিরাম, বিবিধ উদ্ভিদরাজি।
এটি আল্লাহর অনুরাগী বান্দাদের জন্য জ্ঞান ও উপদেশস্বরূপ’ (সুরা কা’ফ ৭-৮)। সমগ্র সৃষ্টি জগতের কল্যাণের জন্য আল্লাহপাক পাহাড়-পর্বত সৃষ্টি করেছেন। ভূমিকম্প, ভূমিধস কিংবা অন্য কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে যাতে মানুষকে নিয়ে এ পৃথিবীর নড়াচড়া করতে না পারে অথবা। সেজন্য আল্লাহপাক পাহাড়গুলোকে পেরেকের মতো গেড়ে দিয়েছেন বলে এরশাদ করেছেন। ‘এবং তিনি পৃথিবীতে সুদৃঢ় পর্বত স্থাপন করেছেন, যাতে পৃথিবী তোমাদের নিয়ে আন্দোলিত না হয়।’ (সুরা আন্ নহল-১৫)।
অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘তিনিই স্থাপন করেছেন ভূপৃষ্ঠে অটল পর্বতমালা এবং তাতে রেখেছেন প্রভুত কল্যাণ।’ (সূরা হা-মীম সাজদা : ১০)। অন্য আয়াতে আছে, ‘আর পাহাড়গুলোকে পেরেকের মতো গেড়ে দিয়েছি।’ (সুরা নাবা-৭)। অথচ আমরা নিজেরাই পাহাড় কেটে, গাছ কেটে, পুকুর ভরাট করে, মারণাস্ত্রের অশুভ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পরিবেশ ধ্বংস করছি এবং পৃথিবীকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলছি।
এই সুবিশাল মহাবিশ্বে পৃথিবী নামক ছোট্ট গ্রহে জীবের বেঁচে থাকার জন্য সব উপাদান দিয়ে আল্লাহ পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। আমাদের কারণে পৃথিবীর পরিবেশ দিন দিন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। ফলে জীবের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার পরিবেশ হারাচ্ছে। মেরু অঞ্চলের বরফ অধিকতর গলে যাওয়ার ফলে বিশ্বের কিছু কিছু নিম্নভূমি বিলীন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
প্রাকৃতিক গ্যাস আহরণে সুষ্ঠু নিয়ম মেনে চলা, মারণাস্ত্রের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত না হওয়া, বন-বনানী থেকে বৃক্ষ উজাড় না করা, পরিকল্পনা ছাড়া ঢালাওভাবে পাহাড় না কাটা, পশু-পাখি নির্বিচারে শিকার না করা, কল-কারখানার বর্জ্য নিষ্কাশনে যথাযথ নিয়ম মেনে চলা, ইটভাটার দূষণ নিয়ন্ত্রণ, যানবাহনের বিষাক্ত ধোঁয়ার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং জনসাধারণকে আরও অধিক সচেতন হওয়া অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় আইন রচনা করে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়াটাও অত্যন্ত জরুরি। আসুন আমরা আমাদের খিলাফতের দায়িত্ব পালনে আরেকটু সচেতন হই। পরিবর্তন শুরু করি, আমরা নিজেদের দিয়েই। আমাদের দ্বারা যেন পরিবেশের কোনো ক্ষতি না হয়।