বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবিলার কার্যকর সমাধান হিসেবে সব সময় বনায়নকেই উৎসাহিত করা হয়। বেশি করে ‘গাছ লাগাও পরিবেশ বাঁচাও’—এমন ধারণার পাশাপাশি গাছ লাগানো কর্মসূচিকে সবচেয়ে ভালো ও কম ব্যয়বহুল উপায় বলে মনে করেন জলবায়ু বিজ্ঞানীরা।
তবে নতুন দুই গবেষণা উল্টে দিল এই ধারণাকে। দুটি গবেষণায় দেখা গেছে, পরিবেশের উপকারের বদলে অধিক হারে বৃক্ষরোপণ উল্টো বিপরীত কাজটিই করে। বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
কয়েক বছর ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের সমাধান হিসেবে গাছ লাগানোর ধারণাটি সত্যই অধিক গ্রহণযোগ্য হয়েছে। স্বল্প খরচে এর প্রভাব অনেক বেশি বলে মনে করা হয়। আগে নানা গবেষণায় বলা হয়, গাছ প্রচুর পরিমাণে কার্বন গ্রহণ ও সংরক্ষণ করতে পারে।
তাই অনেক দেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় তাদের পরিকল্পনার মূল কার্যক্রম হিসাবে বৃক্ষরোপণ অভিযান প্রতিষ্ঠা করেছে। যেমন যুক্তরাজ্যে গত বছরের সাধারণ নির্বাচনের প্রচারেও রাজনৈতিক দলগুলো প্রচুর পরিমাণে গাছ লাগানোর প্রতিশ্রুতি দেয়।
এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও ট্রিলিয়ন ট্রি ক্যাম্পেইন পেছনের সারিতে একটু করে দাঁড়িয়ে আছেন। এমনকি এই ধারণাকে সমর্থন করার জন্য মার্কিন কংগ্রেসে আইন প্রবর্তিত হয়েছে। গাছ লাগানোর আরেকটি বড় উদ্যোগ হলো ‘বন চ্যালেঞ্জ’।
এর উদ্যোগে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের সব দেশকে ৩৫ কোটি হেক্টর অবক্ষয়যুক্ত ও অরণ্য উজাড় করা জমি পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানানো হচ্ছে। এখনো প্রায় ৪০টি দেশ এই ধারণাকে সমর্থন করেছে।
তবে বিজ্ঞানীরা এখন নতুন বনায়নে এত তাড়াহুড়ো না করতে সতর্ক করেছেন। এর আগে অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপর্যয় রোধে বিশ্বজুড়ে বিপুলসংখ্যক গাছ লাগানোটাই সবচেয়ে ভালো উপায়।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিজ্ঞান সাময়িক ‘সায়েন্স’-এ প্রকাশিত সুইজারল্যান্ডের জুরিখে সুইস ফেডারাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (ইটিএইচ জুরিখ) একটি গবেষণায় বলা হয়, কমপক্ষে এক লাখ কোটি গাছ লাগালে বাতাসে কমবে বিষ।
আমাদের বায়ুমণ্ডল হয়ে উঠবে ১০০ বছর আগের মতো। গবেষণায় বলা হয়েছে, শুধু গাছ লাগালেই জীবন বাঁচবে। তবে নতুন এই গবেষণায় এটিই সর্বোৎকৃষ্ট উপায় বলে মনে করছেন না।
‘বন চ্যালেঞ্জের’ ৮০ ভাগ প্রতিশ্রুতিই হলো ঢালাওভাবে গাছ লাগানো। অর্থাৎ বলা যায়, অল্প প্রজাতির কিছু ফলদ গাছ লাগানো। এসব গাছ থেকে ফল হয়। আবার রাবার উৎপাদনও করা হয়।
নতুন একটি গবেষণার লেখকেরা গাছ লাগানোর জন্য বেসরকারি ভূমিমালিকদের আর্থিক সুবিধার বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। এই আর্থিক সুবিধায় গাছের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করার মূলমন্ত্র হিসেবে দেখা হয়। এই গবেষণার মূলক লেখক স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এরিক ল্যাম্বিন। গবেষণায় চিলির উদাহরণ দেওয়া হয়।
লাতিন আমেরিকার এই দেশে গাছ লাগানোর জন্য ভর্তুকি দেওয়ার একটি আইন ১৯৭৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বহাল ছিল। এটি বিশ্বব্যাপী প্রভাবশালী বনায়ন নীতি হিসেবে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল।
চিলির আইন অনুযায়ী, নতুন বন রোপণের ৭৫ শতাংশ ব্যয় সরকার দিত। অবশ্য বলা ছিল, ইতিমধ্যে যে বনগুলো আছে, সেখানে গাছ না লাগিয়ে নতুন বনাঞ্চলের সৃষ্টি করা। তবে আইন বাস্তবায়নে ঢিলেঢালা ভাব এবং বাজেটের সীমাবদ্ধতার কারণে কিছু জমির মালিক দেশীয় বনগুলোর জায়গায় আর্থিক লাভ হবে—এমন গাছ রোপণ শুরু করেন।
গবেষকেরা দেখেছেন, ভর্তুকি প্রকল্পের কারণে গাছ লাগানো যে পরিমাণে বেড়েছে, সে পরিমাণে বনাঞ্চল বাড়েনি। বরং দেশীয় বনের ক্ষেত্রফল কমে যায় উল্লেখযোগ্য হারে।
গবেষকেরা বলছেন, চিলির স্থানীয় বিদ্যমান যে বনাঞ্চল ছিল, তা জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ ছিল এবং প্রচুর পরিমাণে কার্বন সঞ্চয় করার ক্ষমতা ছিল। বরং অনুদান প্রকল্পটি কার্বন সংরক্ষণ বাড়িয়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছিল এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি ত্বরান্বিত করেছিল।
এরিক ল্যাম্বিন বলেন, যদি বৃক্ষরোপণকে উৎসাহিত করার নীতিগুলো ভুলভাবে নকশা করা হয় ও সঠিকভাবে প্রয়োগ না করা হয়, তবে কেবল জনসাধারণের অর্থ নষ্টই নয়, কার্বন সংরক্ষণ কমানো এবং জীববৈচিত্র্য হারানোর ঝুঁকি রয়েছে। এই নীতিগুলোর যে লক্ষ্য, ঠিক এর বিপরীত কাজ করে।
আরেকটি গবেষণায় দেখা হয়, একটি নতুন রোপিত বন বায়ুমণ্ডল থেকে কতটা কার্বন শোষণ করতে সক্ষম। এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা মনে করেন, গাছ একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে কার্বন বায়ু থেকে শোষণ করতে পারে।
গবেষকেরা ধারণা করছিলেন, এই নির্দিষ্ট অনুপাত অঞ্চলভেদে আলাদা। গবেষকেরা চীনের উত্তরাংশ নিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলেন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গোবি মরুভূমি থেকে ধুলাবালু কমানোর প্রয়াসে চীনা সরকার এখানে নিবিড়ভাবে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি গ্রহণ করে। সেখান থেকে ১১ হাজার মাটির নমুনা পরীক্ষা করেন বিজ্ঞানীরা।
দেখতে পান, যেসব মাটিতে কার্বনের পরিমাণ কম, নতুন গাছ লাগানোর ফলে ওই মাটিতে জৈব কার্বনের ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে যেখানের মাটি ইতিমধ্যেই কার্বনে সমৃদ্ধ, সেখানে নতুন গাছ লাগানোর ফলে এই ঘনত্ব হ্রাস পেয়েছে। তাই গবেষকেরা এই উপসংহারে এসেছেন, নতুন গাছ লাগানোর মাধ্যমে জৈব কার্বন বাড়ে—এমন অনুমান সম্ভবত একটু বাড়িয়েই বলা।
এই গবেষণার লেখক কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক আনপিং চেং বলেন, ‘বনায়নের অনুশীলনই চূড়ান্ত সমাধান নয়। বনায়নের সঙ্গে বিভিন্ন অংশের অনেক প্রযুক্তিগত বিবরণ এবং ভারসাম্য জড়িত। এটি আমাদের সব জলবায়ু সমস্যা সমাধান করতে পারে না।’