ধরিত্রী দিবস (Earth Day): গ্রেটা থুনবার্গ মহামারীর পরে ‘নতুন পথ’ এর জন্য আহ্বান জানান
– আশফাকুর রহমান নিলয়
২২ এপ্রিল ছিল ৫০তম বিশ্ব ধরিত্রী দিবস। এদিন গ্রেটা থুনবার্গ বিশ্ববাসীদেরকে করোনাভাইরাস মহামারীর পরে একটি নতুন পথ বেছে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, তিনি বলেন যে “আমাদের সমাজ টেকসই নয়।”
সুইডিশ জলবায়ু কর্মী বলেন যে, কোভিড-১৯ এর ফলে বিশ্বজুড়ে সৃষ্ট শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া(response) প্রমান করে যে মানবতা একত্রিত হওয়ার ফলে কীভাবে পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে এবং বিজ্ঞানীদের পরামর্শে কিভাবে সবাই একইভাবে মহামারীটি প্রতিরোধে কাজ করেছে।
তিনি আরও জানান যে, জলবায়ুর সংকটের ক্ষেত্রে একই নীতি প্রয়োগ করা উচিৎ হবে।
গ্রেটা থুনবার্গ ধরিত্রী দিবস এর ৫০ তম বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সভায় ইউটিউব দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলেন যে, “আমাদের পছন্দ হোক বা না হোক, বিশ্ব পরিবর্তিত হচ্ছে।
এখনকার অবস্থা কিছু মাস আগের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, পূর্বের অবস্থায় আর দেখা নাও যেতে পারে। আমাদেরকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য নতুন পথ নির্বাচন করতে হবে।”
তিনি আরও বলেন যে, “যদি করোনাভাইরাসের সংকট আমাদের একটি বিষয় স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছে যে, তা তা হলো আমাদের সমাজ টেকসই নয়। যদি একটি ভাইরাস কয়েক সপ্তাহের মধ্যে অর্থনীতি ধ্বংস করে দিতে পারে, তবে এটি দেখা যায় যে, আমরা দীর্ঘমেয়াদী কিছু নিয়ে চিন্তাভাবনা করছি না এবং ঝুঁকি বিবেচনায় নিচ্ছি না।”
গ্রেটা থুনবার্গ একজন সুইডিস কিশোরী জলবায়ু দূষণ রোধে বিশ্ব বিখ্যাত প্রচারক, যিনি কিনা বিশ্বজুড়ে জলবায়ু দূষণ রোধে স্কুল ধর্মঘট আন্দোলন শুরু করেন, তাকে বিখ্যাত পরিবেশ ও বিশ্ব টেকসই উন্নয়ন বিজ্ঞানী (earth systems scientist) এবং পটসডাম ইনস্টিটিউটের পরিচালক জোহান রকস্ট্রমের সাথে ডিজিটাল আলাপচারিতায় স্টকহোমের নোবেল পুরস্কার জাদুঘরে চিত্রায়িত করা হয়।
তিনি বলেন যে, মহামারী এবং পরিবেশগত সংকটের মাঝে একটি শক্তিশালী পারস্পারিক সম্পর্ক রয়েছে। বন উজাড় হয়ে যাওয়া এবং বন্যপ্রাণীর বাণিজ্য ভাইরাসের প্রজাতির সীমানাকে বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে আশংকাকে বাড়িয়ে তোলে।
বায়ুদূষণ শ্বাসযন্ত্রকে দূর্বল করে দিয়ে মানুষের দূর্বলতাকে বাড়িয়ে তোলে এবং বিমান ভ্রমণের বৃদ্ধি মহামারীকে দ্রুত ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করে। তিনি আরও বলেন যে, “বৈজ্ঞানিক প্রমাণে দেখানো হয়েছে যে, এগুলো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং এই গ্রহের সংকটের অংশ।
আমরা গ্রহের ধারণ ক্ষমতার বাহিরে বসবাস করছি, তাই আমরা মানব স্বাস্থ্য এবং প্রকৃতির স্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছি।”
লকডাউন(Shut down) কার্বণ নিঃসরণকে হ্রাস করেছে এবং তেল শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে, যা কিনা গ্রিনহাউজ গ্যাসের সবচেয়ে বড় উৎস এবং যা গ্রহকে মারাত্মক পর্যায়ে উত্তপ্ত করছে।
কিন্তু ২ জন বক্তা জোর দিয়ে বলেন যে, ভাইরাসটিকে পরিবেশগত মহামারী হিসেবে দেখা ঠিক নয়, কারণ এটি মারাত্মক ধরণের মানবিক দুর্ভোগ বয়ে এনেছে। কেবলমাত্র সাময়িক অবকাশ প্রদান করেছে এবং প্রচারণা, গবেষণা ও জাতীয় সভা থেকে বিক্ষিপ্ত হয়েছে, যা কিনা একটি পরিষ্কার অর্থনীতির রূপান্তরকে খুঁজে পেতে সহায়তা করত।
তারা বলছে যে, মহামারীটির মূল শিক্ষা হচ্ছে সরকারগুলোকে বৈজ্ঞানিক সতর্কতার ক্ষেত্রে আরও অধিক মনোনিবেশ করা প্রয়োজন।
রকস্ট্রম বলেন যে, “আমরা এই আঘাতটিকে অবমূল্যায়ণ করছি, আমাদের প্রদ্ধতিতে আরও আঘাতকে নির্মূল করার মাধ্যম তৈরী করা প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন যে, “বিশ্বব্যাপী মানুষজন অনিশ্চয়তাকে স্বীকার করছে এবং তারা সতর্ক হচ্ছে। জলবায়ুর সম্বন্ধে বিশ্বজুড়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা কতটা বেড়ে যেতে পারে তা আমরা জানি না।
তাই আমি আশা করছি যে, বিজ্ঞান যে স্বীকৃতি দেখাচ্ছে তার মাধ্যমে আমরা মহামারীটি থেকে বের হয়ে আসবো। ঝুঁকি নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ নয়, তবে আমি বিশ্বাস করি যে, করোনার কর্তৃক সৃষ্ট সংকটের ভিতর থেকে নতুন কিছু আসবে। আমরা এই অবস্থা থেকে উতরে যাব, কিন্তু অবশ্যই পিছনের বিশ্বে ফিরে যেতে নয়।”
তিনি আরও বলেন যে, নতুন সবুজ চুক্তির জন্য ইউরোপ, দক্ষিণ কোরিয়া এবং চীনের জন্য অগ্রাধিকারকে নির্ধারণের সময় অর্থনীতির বাহিরে যাওয়ার জন্য এখন আরও বেশি সমর্থন রয়েছে।
কোনো বক্তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারো বা অন্য কোনো নেতার নামকে উল্লেখ করেনি, যারা কিনা মহামারী জনিত ঝুঁকিকে আমলে নেননি অথবা পুনরুদ্ধারের নামে পরিবেশগত সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্য মানকে শিথিল করার জন্য এটিকে ব্যবহার করছে। তবে থুনবার্গ এই বিপদগুলোকে উল্লেখ করেন।
থুনবার্গ বলেন যে, “এই সংকটের সময়ে যেসব লোকেরা জরুরি বিষয়ে বা নিজের স্বার্থকে এগিয়ে নিতে এই জরুরি অবস্থাকে ব্যবহারের চেষ্টা করে, তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে।” তিনি আরও বলেন যে, “আমি যথেষ্ট চাপ দিতে পারি না যে এটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ, আমরা সক্রিয় গণতান্ত্রিক নাগরিক তাই এরকম সংকট যেন কোনো ভুল পথে চলে না যায়।”
এদিকে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল অ্যান্টোনিও গুতেরেস মহামারীটিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ হুমকিরূপে ঘোষণা করে ধরিত্রী দিবসকেকে চিন্হিত করেন, যদিও তিনি বলেন যে পরিবেশগত জরুরি অবস্থা আরও জটিল ছিল।
তিনি বলেন যে, মহামারী-পরবর্তী পুনরূদ্ধার ৬টি লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে হওয়া উচিৎ। পরিষ্কার জগৎ, সবুজ কর্মসংস্থান সৃষ্টি, টেকসই উন্নয়ন জন্য করদাতাদের সমর্থন, ধূসর জমাটবদ্ধতা থেকে সবুজ প্রকৃতিকে অর্থনৈতিক রূপান্তর, অতীতের জীবাশ্ম জ্বালানীতে ভর্তুকির পরিবর্তে সবুজ জ্বালীনীতে ভবিষ্যতে বিনিয়োগ, আর্থিক ব্যবস্থায় জলবায়ু ঝুঁকির অন্তর্ভূক্তি এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার।
একটি নতুন জরীপে উঠে এসেছে যে, এই দৃশ্যপটের জন্য শক্তিশালী সমর্থন রয়েছে। ব্রিটিশদের শতকরা ৬৬ শতাংশ বিশ্বাস করে যে, জলবায়ু কোভিড-১৯ এর মত দীর্ঘমেয়াদী সংকট হিসেবে এবং ৫৮ শতাংশ বিশ্বাস করে যে, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে অগ্রাধিকার দেয়া উচিৎ।
মরির ১৪ টি দেশের সমীক্ষাতে চীন, জার্মানি, ফ্রান্স, ভারত, ইতালি ও জাপানের কাছ হতে ভালো সমর্থন পাওয়া গেছে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়ার মত স্বল্পতম কৌতুহলী দেশগুলোতেও বেশিরভাগ উদ্দীপনা কার্যক্রমগুলোতে সবুজ অগ্রাধিকারকে সমর্থন করেছে।
ক্রমবর্ধমান ভয়ানক জলবায়ু গবেষণা এবং “FridayForFuture” এবং বিলুপ্তি বিদ্রোহের মত সংগঠনের উচ্চমানের প্রচারণার ফলে গত ২ বছরে জনমত নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। বড় বড় ধর্মঘট এবং মিছিল স্থগিত হয়ে গেছে কিন্তু গ্রেটা থুনবার্গ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, রাস্তা নিরাপদ হলে তারা আবার ফিরে আসবে।
গ্রেটা থুনবার্গ বলেন যে, “আমাদেরকে মানিয়ে নিতে হবে, এটিই যা আপনাদেরকে করতে হবে। মানুষেরা মনে করছে যে, আমরা এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসবো এবং তারপরে আমরা আরও কঠোরভাবে চাপ প্রয়োগ করব।”
Source: The Guardian