দেশে ৬৪% মানুষ বনজ সম্পদের উপর নির্ভরশীল
বিশ্বে তিন ভাগের এক ভাগ মানুষ বন ও বনজ সম্পদের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই হার বৈশ্বিক গড়ের প্রায় দ্বিগুণ—৬৪ শতাংশ।
কারণ, দেশের বনের আশপাশের জনগোষ্ঠীরা তো বনের ওপর নির্ভরশীল বটেই, অন্য এলাকার অধিবাসীরাও বনের বাইরের সম্পদ যেমন গ্রামীণ বন, সড়কের পাশের বৃক্ষ ও ব্যক্তিগত জমির বৃক্ষরাজি থেকে সম্পদ সংগ্রহ করেন।
অন্যদিকে বিশ্বের ৩১ শতাংশ এলাকা এখন বনভূমিতে আবৃত। তবে দেশভেদে তা কমবেশি রয়েছে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় বিশ্বের সব দেশকে বনভূমির পরিমাণ ৩০ শতাংশ করার লক্ষ্য বেঁধে দেওয়া হয়েছে। তবে বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে তা কঠিন। দেশে বনভূমির পরিমাণ এখন মোট ভূমির ১৪ দশমিক ১ শতাংশ।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফরেস্ট–২০২২’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বিশ্বে ২৬০ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বনের সম্পদ ব্যবহার করে থাকেন। বাংলাদেশে এই সংখ্যা প্রায় ১০ কোটি ৮০ লাখ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্য প্রাণীর আবাসস্থল ছাড়াও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় বনভূমির গুরুত্ব রয়েছে। ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বনভূমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বিভিন্ন সময় উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়ের গতি ও তীব্রতা কমাতে সুন্দরবন ভূমিকা রেখে আসছে। কিন্তু বনের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা দেশে বনভূমি ধ্বংসের অন্যতম কারণ।
প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন–বাংলাদেশের সাবেক এদেশীয় পরিচালক ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে যে পরিমাণ বনভূমি রয়েছে, তা যথেষ্ট নয়।
দেশের অনেক মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন। তাঁদের জীবিকা ও জ্বালানির অন্যতম উৎস বনের কাঠ, লতাগুল্ম ও অন্যান্য বনজ সম্পদ সংগ্রহ করা। তাঁদের দিকটাও ভাবতে হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষ বনের ভেতরের ও বাইরের যেসব সম্পদ ব্যবহার করেন, তার মধ্যে রয়েছে কাঠ, বাঁশ, গাছের পাতা, ফলমূল ও ঔষধি সামগ্রী।
বিশ্বের অন্যান্য দেশে বনজ সম্পদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে নানা ধরনের বেসরকারি ও বাণিজ্যিক সংস্থা কাজ করে। তবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভিন্ন। দেশে বনজ সম্পদের ৯৮ শতাংশ সংগ্রহ করেন সাধারণ মানুষ, যা তাঁদের জীবন, জীবিকা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যবহৃত হয়।
বন বিভাগের ‘বাংলাদেশের বৃক্ষ ও বনজ সম্পদ–২০১৯’ জরিপ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। এতে ২০১৭–১৮ অর্থবছরে সংগ্রহ হওয়া বনজ সম্পদের একটি আর্থিক হিসাব তুলে ধরা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ওই অর্থবছরে দেশে ৮৫৪ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের বনজ সম্পদ সংগ্রহ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে প্রকৃতি ও বনবিষয়ক বেসরকারি সংস্থা আরণ্যক ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক রাকিবুল হাসান বলেন, দেশে প্রচলিত বনের বাইরে বৃক্ষরাজির বড় অংশ রয়েছে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার জমিতে।
চুক্তির আওতায় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য গাছ লাগায় ও রক্ষণাবেক্ষণ করে বন বিভাগ। অনেক এলাকায় ওই চুক্তি নবায়ন হচ্ছে না। এসব সমস্যার সমাধানের পাশাপাশি নতুন এলাকায় বন সৃজন করা দরকার।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে ১২ দশমিক ৮ শতাংশ এলাকায় বনভূমি ছিল। ২০১৮ সালের মাঠ জরিপে তা বেড়ে ১৪ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
বাংলাদেশ বন বিভাগের প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসেন চৌধুরী বলেন, প্রাকৃতিক বন রক্ষার পাশাপাশি বনের বাইরেও বেশি বেশি গাছ লাগানো হচ্ছে।
ইতিমধ্যে উজাড় হওয়া বন এবং উপকূলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ফাঁকা জমিতে পরিকল্পিতভাবে বৃক্ষরোপণ করা হচ্ছে। বনাঞ্চল বৃদ্ধিতে এসব উদ্যোগ কাজে লাগছে।
বাংলাদেশ বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দেশে বনভূমির পরিমাণ ১৬ শতাংশ করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। লক্ষ্য ধরা হয়েছে ২০৩০ সাল। এই লক্ষ্য পূরণ করতে হলে নতুন করে বন সৃজন করতে হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন সংস্থার পড়ে থাকা জমিতে বনায়ন করা দরকার বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।