ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গাছ উপড়ে পড়ছে
রাজধানীকে প্রায় বৃক্ষশূন্যই বলা চলে। এরপরও এই মহানগরের যে কয়েকটি স্থানে বেশ কিছু গাছ আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস তার অন্যতম। ক্যাম্পাসের নানা ধরনের গাছের ছায়ায় বসে যেমন চলে আড্ডা, তেমনি অনেক শিক্ষার্থী একত্রে বসে পড়াশোনাও (গ্রুপ স্টাডি) করেন। নগরবাসীও নানা উৎসব উপলক্ষে ঘুরতে আসেন সবুজ এই ক্যাম্পাসে।
তবে কিছুদিন পরপরই সবুজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের এখানে–সেখানে গাছ উপড়ে পড়ছে। গত চার বছরে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন অংশে অন্তত ১৫টি গাছ উপড়ে পড়েছে। সর্বশেষ গত মাসে মল চত্বরে উপড়ে পড়ে দুটি গাছ।
এভাবে ক্যাম্পাসে একের পর এক গাছ উপড়ে পড়ার পেছনে কয়েকটি কারণের কথা বলছেন উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা। তাঁদের ভাষ্য, মাটির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ দেশীয় গাছ কেটে বিদেশি গাছ লাগানো, নানা সেবামূলক কাজের (ইউটিলিটি সার্ভিস) জন্য গাছের মূল কাটা পড়া, বয়সের কারণে দুর্বল হয়ে পড়া, চারা উৎপাদন ও রোপণের সময় পলিথিনের ব্যবহার, গাছের যথাযথ পরিচর্যা না করা ইত্যাদি কারণে গাছ উপড়ে পড়ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে থাকা উদ্ভিদ প্রজাতির ওপর ২০ বছর ধরে পর্যবেক্ষণ ও জরিপকাজ পরিচালনা করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ।
২০১৮ সালের জুনে প্রকাশিত এক জরিপে বলা হয়েছে, ক্যাম্পাসে অন্তত ২০টি বিলুপ্তপ্রায়সহ ৫৪১ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। এগুলোর ৫৯ শতাংশ দেশীয় প্রজাতির। এর মধ্যে মেহগনি, রেইনট্রি ও দেবদারুর মতো চার-পাঁচটি প্রজাতির গাছই বেশি।
গত চার বছরে যে ১৫টি গাছ শিকড়সহ উপড়ে পড়েছে, সেগুলোর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার ও হাকিম চত্বর এলাকায় পাঁচটি, মল চত্বরে চারটি, ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাশে দুটি ও কার্জন হল এলাকায় একাধিক গাছ রয়েছে।
সর্বশেষ গত ৭ ও ৮ মে মল চত্বরে উপড়ে পড়ে যথাক্রমে একটি কৃষ্ণচূড়া ও একটি আকাশমণিগাছ। একের পর এক গাছ উপড়ে পড়ার কারণ জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও উদ্ভিদ গবেষক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, একটা কারণ হলো, উপড়ে যাওয়া গাছগুলো ক্যাম্পাসের জন্য উপযুক্ত ছিল না।
দ্বিতীয় কারণ, গাছগুলো নরম, ডালপালা বেশি ও মূলব্যবস্থা কাটা পড়ে যাওয়া। যেমন রাস্তার পাশে যেখানে গাছ লাগানো হয়েছে, সেখানে পরে ড্রেন করা হয়েছে। ড্রেন করতে গিয়ে গাছের মূল কাটা পড়েছে। তৃতীয় কারণ, কিছু গাছ বয়স হওয়ায় উড ভ্যালু (কাঠমূল্য) হারিয়ে ফেলছে। যেমন দেবদারু।
যত বয়স হচ্ছে, গাছগুলো ভেতরের দিকে মুড়ির মতো (ফাঁপা) হয়ে যাচ্ছে। ফলে ওপরে ডালপালা থাকলেও প্রয়োজনীয় সাপোর্ট (দাঁড়িয়ে থাকার সমর্থন) না থাকায় পড়ে যাচ্ছে। তবে ক্যাম্পাসে দেশি গাছের সংখ্যা কম হওয়া সবচেয়ে বড় কারণ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
অধ্যাপক জসীম উদ্দিন আরো বলেন, ‘এ ছাড়া আমাদের দেশে পলিথিনে করে চারা রোপণ করা হয়ে থাকে। এতে গাছের মূল শিকড়টি ছড়িয়ে যায়, পলিথিনে জড়িয়ে থাকে। গাছটির শিকড় মাটির গভীরে যাওয়ার সুযোগ পায় না।’
এই গবেষক বলেন, ‘ক্যাম্পাসে ৫৯ শতাংশ দেশীয় প্রজাতির গাছ থাকলেও সংখ্যার দিক থেকে এদের পরিমাণ কম। বিদেশি গাছের প্রজাতি শতাংশের হিসাবে কম হলেও সংখ্যায় বেশি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস তথা ঢাকা শহর ছিল শালবনের বর্ধিত এলাকা। এই লালমাটির এলাকায় একসময় লালমাটির গাছই ছিল। এই মাটির জন্য আমাদের দেশি গাছ ছিল উপযোগী। যেমন: শাল, কড়ই, গাব, আমলকী, হরীতকী, বহেড়া, কদম, পানি ফল, বরই, পলাশ, শিমুল, উদাল ইত্যাদি।
কিন্তু সেসব কেটে ফেলেছি। ক্যাম্পাসজুড়ে লাগানো হয়েছে বিদেশি গাছ। ক্যাম্পাসের মাটি হয়তো তার বুক ছেদ করে এসব গাছকে নিচে যেতে দেয়নি।’