জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিপদে রয়েছে
দাবদাহে নাকাল দক্ষিণ এশিয়া। এর জেরে এই অঞ্চলের দেশগুলোর ভাবনার পুরোভাগে চলে এসেছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি। অঞ্চলটি এমনিতেই রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল।
এর ওপর জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি এখানকার জন্য বড় এক বাস্তবতা। তাই সম্ভাব্য বিপদ এমনভাবে মোকাবিলা করতে হবে, যাতে মানবিক সংকট এড়ানো যায়।
ভারত ও পাকিস্তানের দাবদাহ, যাকে বলে নজিরবিহীন। শত বছর আগে থেকে তাপমাত্রার রেকর্ড রাখা হচ্ছে। সেই রেকর্ড বলছে, গেল মে মাস ছিল ভারতের জন্য সবচেয়ে উষ্ণ। রাজধানী নয়াদিল্লিতে তাপমাত্রার রেকর্ড হয়েছে ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এর আগে পাকিস্তানের জেকোবাবাদ শহরেও তাপমাত্রার পারদ চড়েছিল ৪৯ ডিগ্রি, যা এখন পর্যন্ত বিশ্বে এপ্রিল মাসে রেকর্ড হওয়া সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা। মার্চ থেকে মে—এই তিন মাসের কিছু সময়ও ছিল অত্যন্ত শুষ্ক। এ সময়কালে ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশেই বৃষ্টিপাত কম হয়েছে যথাক্রমে ৭১ ও ৬২ শতাংশ।
কয়েক সপ্তাহ ধরে তীব্র দাবদাহে নাস্তানাবুদ হলো পাকিস্তানের বেলুচিস্তান অঞ্চল। বছরের এই সময়টায় এত বেশি তাপমাত্রা থাকার নজির নেই বললেই চলে।
মানুষজন ঘরে থাকতে পারেনি, দিনের বেলায় কাজকর্ম বন্ধ রাখতে হয়েছে। পানির ব্যাপক সংকট মানুষের কষ্ট আরও বাড়িয়েছে। তাপমাত্রা যখন চরমে, তখন বিদ্যুৎও ছিল দুষ্প্রাপ্য। দিনের ৯ ঘণ্টা পর্যন্ত তাপানুকূল যন্ত্র ও রেফ্রিজারেটর ব্যবহার করতে পারেনি এই অঞ্চলের অধিবাসীরা।
মূলত এখন গরমে ভারত ও পাকিস্তান ‘ঘামছে’ বটে, তবে এটা পুরো অঞ্চলের সমস্যা। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতির চরম ঝুঁকিতে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়া।
পাকিস্তানের আবহাওয়া বিভাগের তথ্যমতে, এই উচ্চ তাপমাত্রার প্রভাব পড়েছে কৃষিতে, মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর স্বাস্থ্যের ওপর। অতিরিক্ত তাপমাত্রার জেরে গলতে শুরু করেছে গিলগিট-বালটিস্তান ও খাইবার পাখতুনখাওয়ায় সঞ্চিত বরফ। দাবদাহ ভারতের উপদ্রুত অঞ্চলগুলোয় গমের ফলন ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিয়েছে।
আরও চিন্তার কথা, এই উচ্চ তাপমাত্রা এবার গ্রীষ্ম মৌসুম শুরুর দুই মাস আগেই হাজির এবং এটা যে জলবায়ু পরিবর্তনের ফল তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।
এর মানে দেড়’শ কোটি মানুষকে বর্ষা শুরুর আগে অতিরিক্ত দুই মাস তীব্র গরমে নাভিশ্বাস দশা পেরিয়ে আসতে হলো। এ চরম আবহাওয়ার জেরে ভারত ও পাকিস্তানে অন্তত ৯০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।
মূলত ভারত ও পাকিস্তান এখন গরমে ‘ঘামছে’ বটে, তবে এটা পুরো অঞ্চলের সমস্যা। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতির চরম ঝুঁকিতে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়া। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কেবল তাপমাত্রার পারদই চড় চড় করে বাড়বে না, বর্ষাও হবে দীর্ঘমেয়াদি, বাড়বে খরা।
এরই মধ্যে এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান যে এই অঞ্চলের অর্ধেক জনগোষ্ঠী বা ৭৫ কোটি মানুষ গত দুই দশকে জলবায়ুসংক্রান্ত এক বা একাধিক দুর্যোগের মুখে পড়েছে।
শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতি দেখাচ্ছে, খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধের মতো মৌলিক পণ্য যখন মানুষ পায় না, তখন তা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্ম দেয়।
টানা দুই বছর খরায় পুড়েছে আফগানিস্তান, যা দেশটির খাদ্যনিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ভেঙে দিয়েছে। দেশটির জনগণকে এখন এর মূল্য দিতে হচ্ছে। ২০২০ সালের ঘূর্ণিঝড় আম্পানের জেরে ভারত ও বাংলাদেশের প্রায় ৫০ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল।
সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমে বাড়ছে। এর জেরে বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কায় বাড়ছে আকস্মিক বন্যা ও ঝড়ের আঘাত। বাংলাদেশের জন্য এটা বড় উদ্বেগের কারণ যে সাগরপৃষ্ঠের চেয়ে পাঁচ মিটারের কম উচ্চতায় রয়েছে দেশটির দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা।
লাখ লাখ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় চরম মানবিক সংকট সৃষ্টি করতে পারে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব।
২০১৮ সালে বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় অনুমান করা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে এ অঞ্চলের ৪ কোটি মানুষ জলবায়ুজনিত উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। এরই মধ্যে এখানকার শহরগুলোতে ধারণ ক্ষমতার বেশি মানুষ বাস করছে। এতে তারা এমনিতেই খাদ্য, পানি ও বিদ্যুৎ–সংকটের মুখে; পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আরও বড় চাপ তৈরি হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে খাদ্য ও পানি নিরাপত্তাব্যবস্থা ব্যাপকভাবে ভেঙে পড়বে, বাস্তুচ্যুত হবে মানুষ। কিন্তু জনগণের যে অংশ বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে পারবে না, তারা জীবন-হারানোর ঝুঁকিতে পড়বে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সহিংসতা বৃদ্ধি পাবে। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার বিষয়টি ঝুঁকির মুখে—এই বিবেচনায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি আমলে নিতে হবে এবং এটা নানা উপায়ে করা সম্ভব।
প্রথমত, জলবায়ু পরিবর্তন যে একটা বাস্তবতা, তা কিছু সময়ের জন্য মেনে নেওয়া হলেও এখানেই থেমে থাকলে চলবে না। বাংলাদেশ এরই মধ্যে ঝড় ও জোয়ারের কবল থেকে বাঁচতে ৭০০ কিলোমিটারের বেশি বাঁধ নির্মাণসহ এক হাজারের বেশি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কেবল তাপমাত্রার পারদই চড় চড় করে বাড়বে না, বর্ষাও হবে দীর্ঘমেয়াদি, বাড়বে খরা। ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় অনুমান করা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে এশিয়ার ৪ কোটি মানুষ জলবায়ুজনিত উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে।
শ্রীলঙ্কায় বন্যা ঠেকাতে কলম্বোর জলাভূমিকে নতুন করে বিন্যস্ত করা হয়েছে এবং একই লক্ষ্যে গ্রামাঞ্চলে বেশ কিছু অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু আঞ্চলিকভাবে এসব কর্মকাণ্ডের গতি হয় অত্যন্ত কম, নয়তো দুর্নীতিতে পর্যুদস্ত।
এ কারণে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও অর্থায়ন জরুরি, বিশেষ করে এ অঞ্চলের দরিদ্র দেশগুলোর জন্য। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও এর ক্ষয়ক্ষতি কমানোর লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংক এ অঞ্চলের জন্য ২০১৭ সালে ১৪০ কোটি ডলার ও ২০২১ সালে ৩৭০ কোটি ডলার অর্থায়ন করেছে।
এটি একটি ইতিবাচক উদ্যোগ। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোয় প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ অব্যাহত রাখতে দরিদ্র দেশগুলোকে সহায়তায় এ ধরনের আরও উদ্যোগ দরকার।