জলবায়ু পরিবর্তনের কারণগুলোর মধ্যে বিমান চলাচল ৩.৫% দায়ী
-সুলহাত সালেহীন
বৈশ্বিক বিমান চালনায় কার্বণ নির্গমন এবং মেঘলা দ্বারা জলবায়ু পরিবর্তণ হচ্ছে – সূত্র :ম্যানচেস্টার মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি।
নতুন গবেষণা থেকে দেখা যায় জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রভাবিত করে এমন সমস্ত মানবিক ক্রিয়াকলাপের মধ্যে বিমান পরিবহনকে ৩.৫ শতাংশ হিসাব করা হয়েছে। একটি নতুন আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় ২০০০ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত জলবায়ুর উপর বিমানের প্রভাবের অভূতপূর্ব হিসাব এটি।
প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যাচ্ছে যে, বিমান চলাচলে জলবায়ুর উপর যে প্রভাব পড়ে তার দুই-তৃতীয়াংশের নন-কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গমনের জন্য এবং বাকী অংশ কার্বণ ডাই অক্সাইডের জন্য দায়ী।
যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে গত ৫ বছরে বিশ্বজুড়ে অসংখ্য একাডেমিক এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে।
এটমোসফেরিয়াল এনভায়রনমেন্ট জার্নালে প্রকাশিত এই বিশ্লেষনটি ২০০৯ সালের পর প্রথম এমন একটি ফলাফল যা বিমান চলাচলে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ যেমন যাত্রী, বিমান সংস্থা, বিমানের বিনিয়োগকারী ও নীতি নির্ধারকদের উল্লেখযোগ্য ভাবে কাজে আসবে।
গবেষকরা বলেছেন বিমান শিল্পে জলবায়ু পরিবর্তনে অবদান রাখে এমন সমস্ত উপাদান হচ্ছে কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2) এবং নাইট্রোজেন অক্সাইড (NOx) সেই সাথে কনট্রিল প্রভাব এবং কনট্রিল সিরাস যা বড় জেট ইঞ্জিন দ্বারা উৎপাদিত বরফের স্ফটিক থেকে সৃষ্টি হয় এবং জলবায়ু পরিবর্তনে অবদান রাখে। বিমানের ইঞ্জিন হতে নির্গত ধুয়ার মাধ্যমে জলীয়বাষ্প,কালিঝুলি,অ্যারোসোল এবং সালফেট অ্যারোসোল গ্যাসের সূক্ষ কণা বাতাসে ছড়িয়ে দেয়।
এটি একটি অনন্য গবেষণা; কারণ, জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত আন্ত:সরকারী প্যানেল (Intergovernmental Panel on Climate Change- IPCC) কর্তৃক ২০১৩ সালে চালু করা নতুন মেট্রিক ব্যবহার করে জলবায়ুর উপর বিমান চলাচলের হিসাব করার সম্পূর্ণ প্রথম ফলাফল এটি। এই মেট্রিককে “কার্যকর রেডিয়েটিভ ফোর্সিং ( ‘effective radiative forcing -ERF “ বলা হয় এবং ইহা প্রাক-শিল্পায়ানের সময় (১৭৫০) থেকে সূর্য হতে আগত শক্তি এবং পৃথিবী থেকে নির্গত শক্তির মধ্যে ভারসাম্য বৃদ্ধি বা হ্রাস ঘটায়,যা পৃথিবী-বায়ুমন্ডল বিকিরণ বাজেট (earth-atmosphere radiation budget) হিসেবে পরিচিত।
নতুন ERF মেট্রিক ব্যবহার করে গবেষক দল আবিষ্কার করেছে যে, কনট্রিল সিরাসের প্রভাব পূর্বের অনুমানের চেয়ে অর্ধেকের কম, তবে এখনও বৈশ্বিক উষ্ণায়নে এই খাতের সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে এটি। কারণ, ইহা বায়ুমন্ডলে তাপকে পূণ: পূণ:বিকিরণের ফাঁদে ফেলে ভূ-পৃষ্ঠের দিকে ফিরিয়ে দিয়ে এবং মহা আকাশের বের হতে বাধা প্রদান করে ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করছে। দ্বিতীয় বৃহত্তম নির্গমন হিসেবে কার্বন-ডাই-অক্সাইড অবদান রাখে তবে কনট্রিল সিরাসের প্রভাবের বিপরীতে জলবায়ুর উপর কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2) এর প্রভাব বহু শতাব্দী ধরে স্থায়ী হয়।
ম্যানচেস্টার মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমন্ডলীয় বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং বিমান চলাচল, পরিবহন ও পরিবেশ কেন্দ্রের গবেষণা দলের নেতা শীর্ষস্থানীয় লেখক ডেভিড লি বলেছেন, “জীবাস্ম জ্বালাণী (অকটেন, জেট ফুয়েল, প্রেট্রোল ইত্যাদি) এর উপর বিমানের নির্ভলশীলতা, এর থেকে নি:সৃত CO2 এবং অন্যান্য গ্যাস ও বস্তুসমূহের প্রভাব, ক্রমাগতভাবে এর বৃদ্ধি হতে আমরা আজ জলবায়ু পরিবর্তনের উপর বিমানের প্রভাবের মাত্রা বুঝতে পেরেছি, বিশেষত প্যারিস চুক্তি অনুসারে ২০৫০ এর মধ্যে গড় শূণ্য কার্বন নির্গমন এর প্রয়োজণীয়তার আলোকে।”
তিনি আরও বলেন, “সমসাময়িক বায়ুমন্ডলীয় মডেলিং সিস্টেমগুলির জন্য বায়ুমন্ডলীয় রসায়ন এবং মেঘের উপরে বিমানের কার্বন ডাই অক্সাইড ছাড়া নির্গত অন্যান্য গ্যাসের প্রভাব অনুমান করা জটিল চ্যালেঞ্জ। কিভাবে বায়ু চলাচল করে, রাসায়নিক রূপান্তর ঘটে, মাইক্রোফিজিক্স, বিকিরণ এবং পরিবহন প্রভৃতি বায়ুমন্ডলীয় বাস্তব প্রদ্ধতির দ্বারা জলবায়ুর উপর এর প্রভাব হিসাব করা কঠিন কাজ।”
বিশ্বব্যাপী সামগ্রিক ERF সরবরাহের জন্য বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো পৃথক পৃথক বিমানের ERF -এর একটি ব্যাপক বিশ্লেষণ পরিচালনা করেছিলেন। একই রকম গবেষণা চালানো হয়েছিল ১৯৯৯,২০০৫ ও২০০৯ সালে,তবে এই গবেষণাটি সর্বাধিক বিস্তৃত, পূর্ণবিকশিত ও সাম্প্রতিক।
অধ্যাপক লি আরও বলেন, “নতুন গবেষণায় জলবায়ু পরিবর্তনের উপর বিমানের প্রভাবকে অন্যান্য খাতের সাথে তুলনা করা যেতে পারে । অন্যান্য খাত যেমন – সমুদ্র পরিবহন,স্থল পরিবহন এবং শক্তি উৎপাদন তুলনামূলকভাবে ERF পরিমাপের নিয়মিত সেট।”
রিডিং বিশ্ববিদ্যালয় এবং এনসিএএস- এর বায়ুমন্ডলীয় বিজ্ঞানী ড: লরা উইলকক্স যিনি এই গবেষণায় জলীয়বাষ্পের প্রভাব হিসাব করেছেন, তিনি বলেছেন, ”জলবায়ুর বড় পরিবর্তনের জন্য বিমানের বিভিন্ন উপাদানের বৃহৎ প্রভাব রয়েছে। তবে ভালোর দিক হলো পরিবেশ হতে এসব উপাদান সমূহ হ্রাস করার জন্য এই গবেষণাটি আমাদেরকে বিভিন্ন উপায় বের করে দিয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, ”এই বিশাল গবেষণা বিমান চলাচলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব তুলে ধরেছে এবং ভবিষ্যতে আমাদের জীবনযাত্রায় অত্যন্ত মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব এড়াতে পরিবেশগত প্রভাব হ্রাস করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া দরকার।“
অধ্যাপক লি এবং তার দল হিসাব করে দেখেন যে, ১৯৪০ থেকে ২০১৮ এর মধ্যে এ শিল্পের পুরো ইতিহাস জুড়ে বৈশ্বিক বিমানের সংশ্লেষিত কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2) নির্গমনের পরিমান ৩২.৬ বিলিয়ন টন।
গত ২০ বছরেই মোট নির্গমণ হওয়া CO2 এর প্রায় অর্ধেকটিই কেবল এশিয়াতে বিমান, বিমান পথ এবং বিমানের আকারের বৃদ্ধির কারণে ঘটেছে,যদিও বিমান ও জেট প্রযুক্তির উন্নতির জন্য আংশিকভাবে দায়ী; ইঞ্জিন, বৃহত্তর বিমানের গড় আকার এবং উচ্চতা ও দক্ষতা বুদ্ধি যখন একই জায়গাতে আরও অধিক যাএীদের পরিবহনের জন্য বিমানের ক্ষমতা ব্যবহার করা হয়েছে।
গবেষণা দলটি প্রাক্কলন করে পেয়েছে যে এখন পযর্ন্ত ৩২.৬ বিলিয়ন টন CO2 নির্গমনের ১.৫ শতাংশ এ কারণে ঘটেছে। পরবর্তীতে CO2 নয় এমন গ্যাসগুলোর এর প্রভাবগুলো চিহ্নিত করা হলে দেখা যায় বিমান চালনায় পরিচালিত মানুষের ক্রিয়াকলাপ দ্বারা প্রায় ৩.৫ শতাংশ জলবায়ু পরিবর্তনে অবদান রাখে।
গবেষকরা উল্লেখ করেছেন যে ২০১৬ সালের প্যারিস জলবায়ু পরিবর্তন চুক্তিতে জাতীয় নির্গমন হ্রাস লক্ষ্যমাএার অংশ হিসেবে অভ্যন্তরীণ বিমানগুলি অন্তর্ভুক্ত ছিল, তবে আন্তজার্তিক বিমানগুলি নয়,যা বিমানের যাত্রীদের ৬৪% পরিবহন করে। দূর্ভাগ্যক্রমে কৃষিক্ষেএের মতো উৎসগুলির ন্যয় বিমান চালনার ক্ষেত্রেও CO2 ছাড়া নাইট্রাস অক্সাইড এবং মিথেনের ন্যয় অন্য গ্রীণহাউজ গ্যাসগুলোর সরাসরি নির্গমনের প্রভাবগুলি কিয়োটো প্রোটোকলে চিহ্নিত করা হয়নি।
প্রফেসর লি বলেছেন :”এটি স্পষ্ট নয় যে প্যারিস চুক্তির ভবিষ্যত উন্নয়নে বা আন্তজার্তিক বেসামরিক বিমান সংস্থার জলবায়ু পরিবর্তন হ্রাসের আলোচনায় সাধারণত স্বল্পমেয়াদী পরোক্ষ গ্রিনহাউস গ্যাস যেমন নাইট্রোজেন আক্সাইড, কনট্রিল সিরাস, আ্যারোসোল-ক্লাউড ইফেক্ট বা অন্যান্য CO2 নয় এমন গ্যাসগুলোর নির্গমণ বিষয়ে কোন কিছু অন্তর্ভুক্ত থাকবে কিনা।”
তিনি আরও বলেন, ”প্যারিস চুক্তির পাঠ্যক্রমে বিমানের সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি, এবং সে অনুযায়ী,এই শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে মনুষ্যসৃষ্ট গ্রিনহাউস গ্যাস এবং বায়ু মন্ডলে ইতোমধ্যে তৈয়ারী হওয়া গ্রীণহাউজ গ্যাসগুলির মধ্যে ভারসাম্য অর্জনের জন্য বিশ্বব্যাপী গ্রীণনহাউস গ্যাস নির্গমন দ্রুত হ্রাস করতে হবে। “কোভিড-১৯ মহামারী পরিবর্তনের সাথে সাথে বিমানের যাত্রীদের চাপে বিমানে চলাচল বেড়ে গিয়ে অবশেষে প্রত্যাশিত স্তরে ফিরে আসবে, স্থিতিশীল বৃদ্ধি ঘটবে ও কার্বন নির্গমন আরও বৃদ্ধি পাবে এবং এতে অবশ্যই ঐতিহাসিক নি:সরিত কার্বন বায়ুমন্ডল হতে সরিয়ে দিতে বহু শতাব্দীর প্রয়োজন হবে। “
সূতরাং, মনুষ্য সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিমান থেকে CO2 নির্গমন হ্রাসের প্রক্রিয়া অব্যহত রাখতে মনোনিবেশ করতে হবে।
এই সমীক্ষায় এমন একটি সমাধানের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে যাতে কনট্রিয়াল সিরাসের তৈয়ারী প্রতিরোধে বিমানের পথ পূর্ণবিন্যাস করা উচিত। একটি বিমানে অধিকতর দীর্ঘতর পথ পরিভ্রমনের জন্য অধিক জ্বালানি বহন বন্ধ করতে হবে যা বেশি গ্রিনহাউস গ্যাস নি:সরনের জন্য দায়ী।
গবেষণা দলটি এটিও বের করেছ যে কিভাবে জ্বালানি প্রযুক্তি পরিবর্তনের মাধ্যমে নাইট্রোজেন যৌাগ গুলি (NOx) নির্গমন হ্রাস করে CO2 নির্গমন বাড়িয়ে তুলতে পারে।
এই গবেষণার সহ-লেখক যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাসাগর ও বায়ুমন্ডলীয় প্রশাসনের আর্থ সিসেটেম রিচার্স ল্যাবরেটরীর পরিচালক এবং ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিদর্শনকারী অধ্যাপক ডেভিড ফাহী বলেছেন, ” জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কি কি কর্মকাণ্ড ঘটেছে তা সন্ধান করার জন্য এই সমীক্ষা আন্তর্জাতিক সহযোগিতার একটি ভাল অংশ”।
“আমাদের জলবায়ু ব্যবস্থায় বিমানের ভূমিকার জন্য বৈজ্ঞানিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করেছে এবং ভবিষ্যতের মূল্যায়নের ভিত্তিগত তথ্য সরবরাহ করেছে। আমাদের মূল্যায়ন সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের এবং বিমান শিল্পের ভবিষ্যতের কার্বন নির্গমন প্রশমন ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এ গুরুত্বপূর্ণ খাতের জলবায়ু ব্যবস্থা সম্পর্কে ভুল দাবি থেকে সমালোচনামূলক ক্ষেত্রকে রক্ষা করতে সহায়তা করবে।”
(Originally Published at PHY.ORG)