জলবায়ুর বিরুপ প্রভাব
জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় দেশে গ্রহণ করা প্রকল্পগুলির অপ্রতুলতা, অকার্যকারিতা ও অনিয়ম লইয়া খুলনা অঞ্চলের চিত্র প্রকাশিত হইল, যখন বৈশ্বিক এই দুর্যোগসংক্রান্ত শীর্ষ সম্মেলন ‘কপ-২৭’ চলমান মিসরের এক অবকাশ কেন্দ্রে।
প্রচলিত অর্থে ‘প্রভাবশালী’ না হইয়াও সেই সম্মেলনে বাংলাদেশ পাদপ্রদীপে রহিয়াছে কেবল এই কারণে নহে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতের ক্ষেত্রে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলির প্রথম সারিতে রহিয়াছি।
বরং এই কারণেও, যে সকল দেশ বৈশ্বিক এই দুর্যোগ মোকাবিলায় নীতিগত ও আর্থিক প্রস্তুতি সর্বাগ্রে গ্রহণ করিয়াছে, বাংলাদেশ উহারও প্রথম সারিতে।
বস্তুত জলবায়ু পরিবর্তনের অনুঘটকে নূন্যতম ভূমিকা না থাকা সত্ত্বেও এই দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবিলায় স্থানীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি, জলবায়ু-সহিষুষ্ণ প্রযুক্তি উদ্ভাবন, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসন প্রভৃতি লক্ষ্য সম্মুখে রাখিয়া আমরা যে নিজস্ব তহবিল গঠন করিয়াছিলাম, তাহা বিশ্ববাসীকে বিলক্ষণ বিস্মিত করিয়াছিল।
গত এক যুগে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের আওতায় ৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা বরাদ্দক্রমে ৮৪০টি প্রকল্প গ্রহণ করা হইয়াছে। তৃতীয় বিশ্বের একটা দেশে স্বীয় অর্থায়নের গহণ করা প্রকল্পের এইরূপ সংখ্যা ও বরাদ্দ কোনো বিবেচনাতেই অপ্রতুল হইতে পারে না।
কিন্তু মাত্র ১৬টি প্রকল্প ও ৭১ কোটি টাকা যখন খুলনার ন্যায় জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে অন্যতম ‘হটস্পট’ বিবেচিত এলাকায় ‘বাস্তবায়ন’ চলিতে থাকে, তখন ইহার নেপথ্যে ভৌগোলিক সুবিবেচনা ও ভারসাম্য খুঁজিয়া পাওয়া কঠিন বৈকি।
এই তহবিলের অর্থে নগরে উদ্যান ও সড়ক নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হইয়াছে। এমনকি ২০১৭ সালের এপ্রিলে গ্রহণ করা হইয়াছিল ‘সুন্দরবনের সংরক্ষিত বনে স্মার্ট প্যাট্রলিং’ সংক্রান্ত একটা প্রকল্প।
জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় সুন্দরবনের গুরুত্ব আমরা নিশ্চয়ই অস্বীকার করি না। কিন্তু ওই প্রকল্পের আওতায় টহল টিমের জন্য জলযান ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের সঙ্গে জলবায়ুর কী সম্পর্ক, আমাদের বোধগম্য নহে।
স্থানীয় পরিবেশবাদীদের সহিত আমরা একমত যে, তহবিলের আওতায় প্রকল্প বাছাই, অনুমোদন ও বাস্তবায়নে তদারকি ছিল না। নিয়মিত ‘উন্নয়ন’ কাজও যদি জলবায়ু প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়ন করিতে হয়, তাহা হইলে তো সকলই গরল ভেল।
সংশ্নিষ্ট দপ্তরগুলি নিজস্ব তহবিল হইতে অর্থ বরাদ্দ না পাইবার অজুহাতে সাধারণ কাজেও ব্যয় করিয়াছে জলবায়ু তহবিলের অর্থ।
এই পর্যবেক্ষণের সহিত আমরা একমত যে, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলার পরিবর্তে ঐ তহবিল হইতে বরাদ্দ দিবার সময় অধিক দৃষ্টি ছিল দ্রুত বরাদ্দ ও তাহা মর্জিমাফিক ব্যয় করিবার দিকে।
আমরা স্মরণ করিতে পারি, বৎসর দুই পূর্বে বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় গ্রহণ করা মোট সাতটা প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের এক গবেষণায়ও উঠিয়া আসিয়াছিল। সংস্থাটির এই দাবিও যথেষ্ট উদ্বেগজনক ছিল যে, প্রকল্পগুলির অনুমোদন লওয়া হইয়াছিল ‘রাজনৈতিক প্রভাব’ ব্যবহার করিয়া।
অথচ সংশ্নিষ্টদের ইহা মনে রাখা উচিত ছিল- জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত প্রকল্পগুলি অন্য দশটা উন্নয়ন কর্মসূচির সহিত তুল্য হইতে পারে না। এইগুলির সহিত জড়িত দেশ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অস্তিত্বের প্রশ্ন।
আমরা দেখিতে চাইব বিলম্বে হইলেও সংশ্নিষ্টদের বোধোদয় ঘটিয়াছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা-সংক্রান্ত প্রকল্পগুলির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হইয়াছে।