জলবায়ু পরিবর্তনে আমাদের সচেতন হওয়া উচিত
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের গড় তাপমাত্রা বর্তমানে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। একটা সময় এই তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে থাকলেও বর্তমানে আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে।
বিগত ১০০ বছরেই তাপমাত্রা বেড়েছে শূন্য দশমিক সাত ডিগ্রি সেলসিয়াস। গড়ে ১২ হাজার বছর আগের বরফ যুগের পরবর্তীকালে উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১০ গুণ। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির এই প্রক্রিয়াটাই জলবায়ু পরিবর্তন।
জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক প্রভাব দেশে দেশে দূষণ বাড়াচ্ছে। মরু অঞ্চলের বরফ গলছে। এর ফলে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। ২০০৫ থেকে ২০১৫ সালে সারা বিশ্বে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতিবছর বেড়েছে গড়ে তিন দশমিক ছয় মিলিমিটার করে।
যদি ২১০০ সালে পৃথিবীর তাপমাত্রা গড়ে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ে, তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে তিন দশমিক ছয় ফুট। এতে পৃথিবীর অনেক উপকূলীয় অঞ্চল ও শহর পানির নিচে তলিয়ে যাবে। একইসঙ্গে লাগামছাড়া কার্বন নিঃসরণ ভাবিয়ে তুলছে এবং ঝুঁকিতে পড়ছে আগামী প্রজন্মের বেড়ে ওঠা।
আমরা হয়তো স্বপ্ন দেখি কোনো এক দিন হুট করেই পৃথিবীতে আর জলবায়ু পরিবর্তনের চোখ রাঙানি থাকবে না, হারিয়ে যাবে দূষণের ভয়াবহতা। সেই স্বপ্নে একটুখানি হলেও আশা জাগিয়ে যাচ্ছে করোনাভাইরাস।
যদিও মানুষ ও অর্থনীতি থেকে শুরু করে প্রায় সবকিছুতেই স্থবিরতার তালিকাটাই বড় হয়ে উঠছে মহামারির দিনগুলোয়, তবু পরিবেশের জন্য স্বস্তির গল্পই হয়ে থাকবে এই ভাইরাস। দেশে দেশে লকডাউনে প্রকৃতি ফিরেছে তার আপন রূপে। আমাদের দেশেই তো এমন অসংখ্য ঘটনা উদাহরণ হয়ে এসেছে।
আমরা জানি প্রকৃতির এই রূপ একেবারেই ক্ষণস্থায়ী, কারণ মহামারি কেটে গেলে মানুষ ফিরবে তার চেনা ব্যস্ততায়, ফের বাড়বে দূষণ, প্রকৃতিও দূষণের অসহায়ত্ব বরণ করে নিতে দেরি করবে না। প্রকৃতিকে বিরক্ত না করলে, কোনো রকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই যে সে তার মতো করেই বেড়ে উঠতে পারে, সেটির বড় উদাহরণ হয়ে থাকবে মহামারির এই দিনগুলো করোনা অন্তত আমাদের এই শিক্ষাটা দিয়ে যাচ্ছে।
আমরা যে খাদ্য গ্রহণ করি, যে বাতাসে শ্বাস নিই, তৃষ্ণায় পানি পান করি এবং জলবায়ু, যেটি আমাদের গ্রহকে বাসযোগ্য করে তোলে এসবই তো প্রকৃতির নিঃস্বার্থ অবদান।
কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণে গাছের ভূমিকা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রতি বছর সামুদ্রিক গাছপালা আমাদের বায়ুমণ্ডলের অর্ধেকের বেশি অক্সিজেনের জোগান দেয় এবং একটি পরিপক্ব গাছ প্রায় ২২ কিলোগ্রাম কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে বিনিময়ে অক্সিজেন ছেড়ে দিয়ে মানুষের ক্লান্তিহীন উপকার করছে, বাঁচিয়ে দিচ্ছে মানুষের প্রাণ।
শুধু আমাজন বন বছরে দুই হাজার মেগাটন কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। বলা হয়ে থাকে, একজন মানুষের জন্য এক বছরের অক্সিজেন সরবরাহ করতে দুটি পূর্ণবয়স্ক গাছের প্রয়োজন।
আমাদের প্রকৃতি আমাদের যেসব সুবিধা দেয়, বিনিময়ে আমরা তার সিকিভাগ উপকারও স্বীকার করি না, ভালো থাকতে দিই না তার বেড়ে ওঠায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে।
তবু সচেতনতা আর নানামুখী উদ্যোগে চেষ্টা চলেই পরিবেশকে পরিবেশের মতোই বাঁচতে দেওয়ার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত জুন মাসে এক অনুষ্ঠানে প্রত্যেককে তিনটি করে গাছ (ফলদ, বনজ ও ঔষুধি গাছ) লাগানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন।
আমরা খুব আশাবাদী হই এটা দেখে যে, সরকারদলীয় সংগঠন থেকে শুরু করে অসংখ্য মানুষ ব্যক্তিগত উদ্যোগে হোক, কিংবা সাংগঠনিকভাবে হোক এই আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন। গাছ লাগানোটাই যেখানে বড় এক সমাধান হতে পারে পরিবেশ বাঁচানোর প্রয়াসে, সেখানে এমন উদ্যোগ সত্যিকার অর্থেই বোধহয় প্রশংসার দাবিদার।
তবে প্রতিবছরই লাখ লাখ চারাগাছ লাগানো হয়, কিন্তু পরিচর্যার অভাব আর অবহেলায় এসব গাছ আর বেড়ে উঠতে পারে না। এতে করে হয় তারা প্রাণীর খাদ্য হয়, নয়তো নির্মাণকাজে বলির পাঁঠা হতে হয়। একটা গাছকে বেড়ে উঠতে না দিলে সে কীভাবে আমাদের ছায়া দেবে, জোগাবে অক্সিজেন এবং উপহার দেবে নির্মল পরিবেশ?
একটা পরিবারে যখন সন্তান জন্ম নেয়, তখনই কি পরিবারটি তাদের দায়িত্ব শেষ করে দেয়? অবশ্যই না। পরম যত্নে আর আদরে বড় করে তোলে সেই সন্তানকে। সেই সন্তানই বড় হয়ে পরিবারের দায়িত্ব নেয়।
একটা গাছের ক্ষেত্রেও কি তেমন হওয়া উচিত নয়? আমরা চারাগাছ যেমন দায়িত্ব নিয়ে লাগাই, সেই দায়িত্ব প্রসারিত হোক গাছটির বড় হয়ে ওঠা পর্যন্ত। পানি দিয়ে ও সার দিয়ে পরম যত্নে নিয়মিত পরিচর্যায় গাছটিকে বেড়ে উঠতে দিতে হবে আমাদেরই। তবেই না সে প্রতিদান দেবে আমাদের ছায়ায়, অক্সিজেনে কিংবা বাহারি ফলফলাদিতে।
শেষে এসে এই পৃথিবীর সুস্থতার প্রার্থনাই করতে চাই। পৃথিবী একদিন ভাইরাসমুক্ত হবে। শহর থেকে গ্রামে সবুজ আর নির্মল বাতাসের গানে মুখরিত হবে আমার-আপনার-আমাদের সবার চেনা পরিবেশ। প্রকৃতির ভালো থাকায় সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বানে জ্বলুক তারুণ্যের দীপশিখা।