রাজধানীর ফুসফুস ও ঐতিহাসিক স্থান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কেটে চলছে উন্নয়ন মূলককাজ। উদ্যানে ওয়াকওয়ে ও ৭টি ফুড কর্নার বানানোর জন্য ইতিমধ্যে কাটা হয়েছে ৪০টি থেকে ৫০টি গাছ। আরো প্রায় অর্ধশত গাছ পর্যায়ক্রমে কাটা হবে বলে জানা গেছে। স্বাধীনতাস্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ের কাজের অংশ হিসেবে এই উন্নয়নকাজ চলছে। প্রায় ৫০-৯০ বছরের পুরোনো এই গাছ কাটা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে তর্ক-বিতর্ক, চলছে আলোচনা-সমালোচনা এবং আন্দোলন।
উদ্যানের গাছ কাটা বন্ধে সরকারকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, রেস্টুরেন্ট বা দোকান নির্মাণের নামে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী এই উদ্যানের গাছ কাটার কোনো সুযোগ নেই। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এ কার্যক্রম বন্ধ করা না হলে হাইকোর্টে আদালত অবমাননার মামলা করা হবে।
পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো দাবি করছে, শিমুল, জারুল, গগনশিরিষ, রয়্যাল পামসহ অন্তত ১০০ গাছ কাটা হয়েছে। কংক্রিটের স্থাপনা তৈরি করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে তারা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সব প্রবেশপথসহ বিভিন্ন স্থানে অন্তত সাতটি ফুডকর্নার স্থাপন করার কাজ শুরু করেছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। তাদের দাবি, এ জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমোদনও রয়েছে। অভিযোগ উঠেছে রাতের আঁধারে গাছ কেটে নেওয়া হয়েছে। উদ্যান এলাকায় রেস্তোরাঁ তৈরি করতে বড় আকারের সাতটি স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি রেস্তোরাঁর নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে।
পরিবেশবাদী সংগঠনের প্রতিবাদ
গাছ কাটায় বেশ কয়েক দিন যাবত্ প্রতিবাদ করে আসছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। তারা উদ্যান এলাকায় প্রতিবাদী ব্যানার, মানববন্ধন ও বিভিন্ন শিল্পকর্মের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। ষোল আনা বাঙালি নামে সংগঠনের পক্ষে লাগানো ব্যানারে লেখা হয়েছে, ‘পরিবেশ প্রকৃতির অলংকার, বাংলাদেশ আমার অহংকার; গাছ কাটা বন্ধ করো।
নোঙর বাংলাদেশ, স্বাধীনতা উদ্যান সাংস্কৃতিক জোট, গ্রিন প্লানেট নামে তিনটি সংগঠন গাছ কাটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে। গত বুধবার উদ্যান গেটে একটি মানববন্ধনের আয়োজন করেন তারা।
বৃহস্পতিবার উদ্যান এলাকায় শিক্ষার্থীরা আরেকটি মানববন্ধন করেন। মানববন্ধন থেকে তরুণ নাট্য নির্মাতা সুদীপ সজীব বলেন, সৌন্দর্যবর্ধনের নামে গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। যেখানে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে প্রকৃতি বাঁচিয়ে রেখে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়, সেখানে আমাদের দেশে গাছ কেটে হাঁটার পথ, খাবারের দোকান বানানো হচ্ছে। একটু চেষ্টা করলেই গাছগুলো বাঁচানো যেত। উদ্যানের এ গাছ হত্যার মাধ্যমে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
উদ্যানের বিভিন্ন প্রবেশ মুখে কবিতা, গান ও পথনাটকের মাধ্যমে এসব প্রতিবাদ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়।
কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীরা অবিলম্বে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটা বন্ধ করে ১০ হাজার গাছ রোপণেরও দাবি জানান। উদ্যানকে ঢাকার ফুসফুস হিসেবে উল্লেখ করে এটি রক্ষায় সরকারকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও জানিয়েছেন তারা।
এটাকে পুঁজিবাদী উদ্যোগ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আমাদের কাছে ফুসফুস আর পুঁজিবাদীদের কাছে তা ব্যবসা। পুঁজিবাদ সব দিক থেকে পরিবেশকে ধ্বংস করে ফেলছে। পাহাড় কেটে ভবন বানাচ্ছে, গাছ কেটে বানাচ্ছে রেস্তোরাঁ। এটা মর্মান্তিক। কোনোভাবেই গাছ কেটে পরিবেশ ধ্বংস করা যাবে না।’
ঐতিহাসিক এই উদ্যানেই কেন খাবার হোটেল করতে হবে? গাছ রেখেই কি হাঁটার রাস্তা তৈরি করা যেত? সবাই যখন গাছ বাঁচায়, আমাদের কেন গাছ কাটতে হবে? গাছ কাটার কেমন প্রভাব পড়বে? দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, নগর বিশ্লেষক ও শিক্ষাবিদ স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন ও ঢাবির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুনের সঙ্গে।
শিক্ষাবিদ ও ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী গাছ কাটার বিষয়ে বলেন, ‘এটা অত্যন্ত অন্যায় কাজ। আমাদের এই শহরে এমনিতেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক গাছ নেই। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এই গাছ কাটা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য না। এটা সবদিক থেকে কেবলমাত্র ক্ষতিরই কারণ হবে। গাছ কাটার কারণে শুধু এখানেই ক্ষতি হবে তাই না, এখান থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে উন্নয়নের নামে অন্য জায়গা থেকেও গাছ কাটা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শহরের একটা বড় জায়গা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। এখানে সবই থাকবে, মানুষ যাবে। কিন্তু কোনো কারণেই গাছ কাটা যাবে না। যত উন্নয়নই হোক, গাছ রেখেই করতে হবে। গাছ কেটে এই উন্নয়ন হওয়ার অর্থ এটা একটা নিদর্শন হয়ে থাকা। অবিলম্বে এই গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে। যেসব জায়গা থেকে গাছ এরই মধ্যে কেটে ফেলা হয়েছে সেখানে দ্রুত আরও গাছ লাগাতে হবে। যে উন্নয়ন পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে, সেটা সংশোধন করতে হবে। গাছ কাটায় অনেকে আন্দোলন করছে, সেটা তো হবেই।’
স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গ্লাস টাওয়ার তৈরি কমিটির সদস্যদের মধ্যে আমি একজন। সেখানে পরবর্তীতে মার্বেল পাথর বসানো হয়েছে, যা আমাদের পরামর্শে নয়। একটি প্রতিষ্ঠানকে তাদের আমদানি করা মার্বেল পাথর বসানোর সুযোগ দিতেই এটা করা হয়েছিল। এর ফলাফল দাঁড়িয়েছে, দিনের বেলায় এখন আর ওখানে হাঁটা যায় না। রোদের কারণে যে পরিমাণ তাপ সৃষ্টি হয় তাতে চোখ দিয়ে পানি চলে আসে। পরবর্তীতে আমরা সিদ্ধান্ত দিয়েছিলাম সেখানে মাঝে মাঝে মার্বেল তুলে সবুজ ঘাস লাগাতে। যাতে কিছুটা হলেও এই সমস্যাটা কমে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নতুন যে উন্নয়ন পরিকল্পনা দেখছি, তাতে রয়েছে টাইলস লাগানো, ইট লাগানো। এর সবই প্রচুর পরিমাণে তাপ তৈরি করবে। আবার এর জন্য গাছও কাটা হবে। গাছ তো শুধুই একটি গাছ নয়। এটা একটা অক্সিজেন তৈরির প্ল্যান্ট। সে অক্সিজেন তৈরি করছে এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড টেনে নিচ্ছে। অর্থাৎ বিনামূল্যে বিষ টেনে নিয়ে অক্সিজেন দিচ্ছে। অথচ, সেই গাছ আমরা কেটে ফেলছি কারো ইট আবার কারো টাইলসের মার্কেটিং করার জন্য। অন্তত পরিকল্পনাটি দেখে আমার তাই মনে হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘হাঁটার রাস্তায় টাইলস বসালে সেটা তো গাছ রেখেও বসানো যেতে পারে। সেটা করা হলে বরং সূর্যের আলোর কারণে এই টাইলস থেকে আর তাপ উৎপন্ন হবে না।’
এই উদ্যানে গাছ লাগানোর প্রারম্ভিক সময়ের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পিডব্লিউডি থেকে প্রথম ল্যান্ডস্কেপিংয়ের ওপর পড়াশোনা করে এসে একজন স্থপতি এই উদ্যানে গাছ লাগানোর পরিকল্পনাটা তৈরি করেছেন। সে সময় আমিও ছিলাম তার পাশে। কোথায় কোন গাছ হবে, গাছগুলোর একটি থেকে অপরটির দূরত্ব কেমন হবে, কোন গাছের পাতা কতটা ছড়াবে, এভাবে তিনি এই পরিকল্পনা করেছিলেন। তার পরিকল্পনায় এই উদ্যানটি ছিল ঢাকার হৃৎপিণ্ড। ১৯৭৩ সাল থেকে তিনি নিজে দাঁড়িয়ে গাছগুলো লাগিয়েছিলেন। গ্লাস টাওয়ার তৈরির জন্য ইতোমধ্যেই আমরা অনেক গাছ কেটেছি। সেই অভাবটাও চারপাশের গাছ দিয়ে কিছুটা সমন্বয় করা সম্ভব। কিন্তু, রেস্টুরেন্ট আর গ্যাদারিং করার জন্য গাছ কাটার পরিকল্পনা করা হচ্ছে কেন? গাছের নিচে মানুষ বসতে পারে না? গাছগুলোর চারপাশেই তো বসার ব্যবস্থা করা সম্ভব।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন বলেন, ‘এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার। আপনি যদি লন্ডনে যান, সেখানে আধঘণ্টা হাঁটলেই পার্কের দেখা পাবেন। সেগুলো অত্যন্ত চমৎকার, সবুজ। ঢাকায় এর চেয়ে বেশি পার্ক থাকা উচিত। কারণ, এখানে মানুষের ঘনত্ব অনেক বেশি। কিন্তু হয়েছে তার উল্টো। আমি যখন ছাত্র, তখন এই উদ্যানটি বেশ সবুজ ছিল। সময় যত যাচ্ছে, এই উদ্যানের গাছ কেটে যোগ করা হচ্ছে কংক্রিট। স্বাধীনতা স্তম্ভ তৈরির সময় কতটা কম কংক্রিট ব্যবহার করা যায়, তা ভাবার সুযোগ ছিল। এর ভেতরে একটা মন্দির আছে, পুলিশেরও একটা জায়গা আছে। এখন আবার রেস্টুরেন্ট তৈরির জন্য গাছ কাটতে হচ্ছে। উদ্যানের ভেতরে রেস্টুরেন্ট কেন বানাতে হবে?’