কুষ্টিয়া এক গ্রামেই রয়েছে ১৪ অবৈধ ইটভাটা, হুমকিতে কৃষিজমি ও পরিবেশ
কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চরসাদিপুর ইউনিয়নের চাঁদপুর গ্রাম। প্রায় চার বর্গকিলোমিটারের গ্রামটিতে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার মানুষের বসবাস।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার জন্য গ্রামে আছে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি কমিউনিটি ক্লিনিক। ঘনবসিতপূর্ণ এই গ্রামেই আইন ভেঙে কৃষিজমিতে গড়ে উঠেছে প্রায় ১৪টি ইটভাটা, যার অন্তত ৮টি চলতি বছর নির্মাণ করা হয়েছে।
অবৈধ ইটভাটায় কৃষিজমি ও পদ্মা নদীর তীরের মাটি নিয়ে ইট তৈরি করা হচ্ছে। জ্বালানি হিসেবে পোড়ানো হচ্ছে বিভিন্ন গাছের কাঠ।
এতে কৃষিজমির পরিমাণ কমে যাওয়ার পাশাপাশি ভাটার আশপাশের ফসল ও ফসলি জমি হুমকিতে পড়েছে। অবাধে অবৈধ যান চলাচলে ভেঙে পড়েছে গ্রামীণ যোগাযোগব্যবস্থা। নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ।
চরসাদিপুর ইউনিয়নের বাসিন্দারা বলছেন, চাঁদপুর ছাড়াও ইউনিয়নে আরও অন্তত ৩০টি ইটভাটা আছে। সব কটিই অবৈধ। বেশির ভাগ ভাটায় ব্যবহার করা হয়েছে নিষিদ্ধ ড্রাম চিমনি।
বিষয়টি জানতে পেরে শনিবার চরসাদিপুর ইউনিয়নে অভিযান চালায় কুমারখালী উপজেলা প্রশাসন ও জেলা পরিবেশ অধিদপ্তর। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত অভিযানে বৈধ কাগজপত্র না থাকা, ফসলি জমি ব্যবহার, কয়লার পরিবর্তে কাঠ পোড়ানোসহ বিভিন্ন অপরাধে ৮টি ভাটার মালিককে ২০ লাখ টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আমিরুল আরাফাত। এ সময় সেখানে জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, র্যাব ও পুলিশ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, কুষ্টিয়া জেলা ও কুমারখালী উপজেলা থেকে চরসাদিপুর ইউনিয়নকে বিচ্ছিন্ন করেছে পদ্মা নদী। নৌকাযোগে ওই এলাকায় যেতে হয়। ফলে প্রশাসনের তেমন নজরদারি থাকে না।
এভাবে দিনের পর দিন ওই এলাকায় অবৈধ ইটভাটা তৈরি হয়েছে। মালিকেরাও স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী। পদ্মা নদীর কূল ঘেঁষে প্রায় ২২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের চরসাদিপুর ইউনিয়নে প্রায় ২৫ হাজার মানুষের বাস।
বিভিন্ন সময়ে ভাঙনে প্রায় পাঁচ বর্গকিলোমিটার ইতিমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। অবশিষ্ট এলাকায় আইন অমান্য করে প্রায় ৩০টি ইটভাটা গড়ে উঠেছে, যার সব কটিই অবৈধ।
পদ্মা নদীর তীর ও চরাঞ্চলের দুই ও তিন ফসলি জমিতে চিমনি ও ড্রাম চিমনি ইটভাটা নির্মাণ করেছেন মালিকেরা। প্রতিটি ভাটায় ১৫-২০ বিঘা কৃষিজমি ব্যবহার করা হয়েছে।
কয়লার বদলে ভাটায় পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। ট্রলিসহ বিভিন্ন অবৈধ যানে পদ্মাঘেঁষা কৃষিজমি থেকে মাটি আনা হচ্ছে ভাটায়।
ইউনিয়নের ভৈরবপাড়া গ্রামের কৃষক রজব আলী বলেন, তাঁর সাড়ে চার বিঘা ফসলি জমি জোর করে দখল করে অবৈধ ইটভাটা চালাচ্ছেন প্রভাবশালী মোহাম্মদ শহিদ ও তাঁর তিন ভাই।
জমি উদ্ধার ও অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, পরিবেশ অধিদপ্তর, থানা ও আদালতে মামলা করেও তিনি প্রতিকার পাননি।
সাদিপুর গ্রামের আবুল হোসেন বলেন, সরু রাস্তায় বড় বড় ট্রাক ও ট্রলি চলাচল করে। রাস্তাঘাট ভেঙে যাচ্ছে। রাস্তার পাশের ঘরবাড়ি ধুলাবালুতে ভরে যায়। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে মানুষ।
ভাটার মালিকদের কাছে জিম্মি এলাকাবাসী। কলেজছাত্র মিজানুর রহমান বলেন, প্রশাসনের নজরদারির অভাবে দিন দিন চরসাদিপুর ইউনিয়নে অবৈধ ভাটার সংখ্যা বাড়ছে। সেখানে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বসবাসের পরিবেশ নেই।
চরসাদিপুর ইউনিয়ন ভাটা মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শহিদ বলেন, ১০ বছর আগে তিনিই প্রথম ভাটা তৈরি করেছিলেন। দিনে দিনে ভাটার সংখ্যা বেড়েছে।
তাঁর জানামতে, বর্তমানে সেখানে ২২টি ভাটা চলছে। সবাইকে ঠিক করেই তাঁরা ভাটার ব্যবসা করছেন বলে জানান।
চাঁদপুর গ্রামের এবিসি ব্রিকসের মালিক ওসমান গনি ও ভাটার ব্যবস্থাপক আবদুল্লাহ বলেন, সেখানকার জমিতে তেমন ফসল হয় না। ইটের ভাটায় লাভ বেশি। তাই তাঁরা কয়েকজন বন্ধু মিলে ড্রাম চিমনির ভাটা চালাচ্ছেন।
এ জন্য পরিষদের চেয়ারম্যানকে ট্রেড লাইসেন্স বাবদ ১৭ হাজার টাকা, কাস্টমসকে ভ্যাট বাবদ ৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠান বাবদ উপজেলা প্রশাসনকে মোটা অঙ্কের টাকা দেওয়া হয় বলে দাবি করেন তাঁরা।
চরসাদিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেছের আলী খাঁ বলেন, তিনি প্রথমবারের মতো চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। অনেক আগে থেকেই ভাটাগুলো চলছে।
তাঁর জানামতে, বর্তমানে ২৫-২৬টি ভাটা আছে, যার সব কটিই অবৈধ। অতিরিক্ত ভাটা ও অবৈধ যান চলাচলে মানুষের খুবই ভোগান্তি হচ্ছে। প্রশাসনের মাধ্যমে অবৈধ ভাটা বন্ধের দাবি জানান তিনি।
পরিবেশ অধিদপ্তর কুষ্টিয়ার উপপরিচালক আতাউর রহমান বলেন, অবৈধ ভাটা উচ্ছেদে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছেন তাঁরা। যোগাযোগব্যবস্থা না থাকায় চরসাদিপুরে এক্সকাভেটর (ভেকু) দিয়ে ভাটা গুঁড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয় না। তবে অবৈধ ভাটা বন্ধে মালিকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে বলে তিনি জানান।
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আমিরুল আরাফাত বলেন, বৈধ কাগজপত্র না থাকা, কৃষিজমি ব্যবহার, কয়লার বদলে কাঠ পোড়ানোসহ নানা অপরাধে ৮টি ভাটার মালিককে ২০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সময়স্বল্পতার কারণে সব ভাটায় অভিযান চালানো সম্ভব হয়নি। পর্যায়ক্রমে সব অবৈধ ভাটায় অভিযান চালানো হবে।