সুইডেনের অধিবাসী গ্রেটা থুনবার্গ। মাত্র ১৬ বছর বয়সে পুরো পৃথিবী জুড়ে সাড়া ফেলে দিয়েছেন এই কিশোরী পরিবেশবাদী। তার ডাকে পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে জড়ো হয়েছেন বিভিন্ন দেশের নানা বয়স ও শ্রেণি-পেশার প্রায় অর্ধকোটি মানুষ। খুব কম মানুষই এখন পাওয়া যাবে যে ছোট্ট এই মেয়েটির নাম শোনেনি।
২০০৩ সালের ৩ জানুয়ারি সুইডেনের স্টকহোমে জন্ম গ্রেটার। ওপেরা শিল্পী মা মালেনা এর্নমান, অভিনেতা বাবা স্ভান্তে থানবার্গ এবং অভিনেতা ও চলচ্চিত্র পরিচালক দাদা ওলফ থানবার্গের ভীষণ আদরের মেয়েটির ছোটবেলায়ই একটি সমস্যা ধরা পড়ে। ডাক্তার পরীক্ষা করে জানান, তার ‘অ্যাসপার্গার’স’ নামক এক ধরনের অটিজম রয়েছে।
এই অ্যাসপার্গার’স সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুর সামাজিক যোগাযোগ এবং অবাচনিক পদ্ধতিতে ভাবের আদানপ্রদান করতে উল্লেখযোগ্য মাত্রার সমস্যা হয়। এছাড়াও আরও কিছু বিকাশগত জটিলতা থাকতে পারে শিশুটির।
এই অ্যাসপার্গার’স সিনড্রোমের ধারাবাহিকতায় তার মধ্যে অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার (ওসিডি) এবং সিলেকটিভ মিউটিজমের মতো আরও দু’টি মানসিক বিকাশগত জটিলতা শনাক্ত হয় গ্রেটার মাঝে।
অবশ্য স্পষ্টবাদী গ্রেটার তাতে দুঃখ নেই। তিনি মনে করেন, এই অটিজমের কারণেই তিনি ‘গণ্ডির বাইরে গিয়ে’ ভাবতে পেরেছেন।
তবে এটুকু ছাড়া অন্যদের থেকে নিজেকে কখনোই আলাদা ভাবেন না তিনি। ‘আমি যদি অন্যদের মতো না হতাম তবে ক্লাস বাদ দিয়ে ধর্মঘটে বসতাম না।’
সত্যিই হয়তো তাই। অনেক আগে থেকেই পরিবেশ রক্ষা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন গ্রেটা থুনবার্গ। তিনি জানান, ২০১১ সালে তিনি প্রথম জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে জানতে পারেন। তখন তার বয়স মাত্র ৮ বছর। তিনি বুঝতেই পারছিলেন না, বিষয়টি যদি এতটাই গুরুতর হয় তবে কেন এ নিয়ে কিছু করা হচ্ছে না।
এর বছর তিনেক পর গ্রেটার আচরণে পরিবর্তন দেখা যেতে শুরু করে। তিনি কেমন যেন অবসন্ন এবং নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। দেখতে দেখতে খাওয়াদাওয়া এবং কথা বলা বন্ধ করে দেন গ্রেটা। ওই সময়ই চিকিৎসক পরীক্ষা করে জানান তার অটিজমের কথা।
এর পরবর্তী প্রায় দু’বছর গ্রেটা তার বাবা-মাকে চ্যালেঞ্জ করলেন পরিবারের প্রাত্যাহিক কর্মকাণ্ডে কার্বন বর্জ্য ও কার্বন নিঃসরণ কমাতে। এজন্য পরিবারের সবাইকে তৃণভোজী হওয়ার এবং আকাশপথে সফর বন্ধ করার দাবি জানালেন এই কিশোরী।
গ্রেটার ভাষায়, একটা সময় বাবা-মা তার দাবি মেনে নিয়ে তার বিশ্বাস ও স্বপ্নের পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছেন।
তবে গ্রেটা কঠোর কর্মসূচি শুরু করেন গত বছর, যার কারণে তিনি পরিচিতি পেতে শুরু করেন জাতীয় পরিসরে।
২০১৮ সালে ১৫ বছর বয়সী গ্রেটা থুনবার্গ সবে পড়তেন নবম শ্রেণিতে। তীব্র তাপপ্রবাহ ও দাবানলে সুইডেনের অবস্থা ভয়াবহ। আবহাওয়ার রেকর্ড অনুসারে, ২০১৮ সাল ছিল সুইডেনের গত ২৬২ বছরের মধ্যে উষ্ণতম গ্রীষ্মকাল।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় উপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না বলেই প্রকৃতি এত প্রতিকূল হয়ে উঠছে বলে শনাক্ত করেন গ্রেটা। তাই ওই বছরের ২০ আগস্ট সিদ্ধান্ত নেন ক্লাসে না গিয়ে ৯ সেপ্টেম্বরের সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত আন্দোলন করবেন তিনি।
গ্রেটার দাবি ছিল, সুইডিশ সরকারকে অবিলম্বে প্যারিস চুক্তির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেশে কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে। এজন্য তিনি দেশের পার্লামেন্ট ‘রিকসদাগ’র সামনে টানা তিন সপ্তাহ বসে আন্দোলন করেছেন।
হাতে ছিল ‘ঝশড়ষংঃৎবলশ ভস্খৎ শষরসধঃবঃ’ (জলবায়ুর জন্য স্কুল ধর্মঘট) লেখা প্ল্যাকার্ড। এমনকি তিনি আশপাশ দিয়ে যাওয়া সবাইকে লিফলেটও বিতরণ করছিলেন, যেখানে লেখা ছিল: ‘আমি এটা করছি কারণ তোমরা বড়রা আমার ভবিষ্যৎ ধূলিস্যাৎ করে দিচ্ছো।’
গ্রেটার এসব কাজ অনুপ্রাণিত করেছে স্কুলের ছোট ছোট শিশু থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন বয়সের মানুষকে। তার চেষ্টার জন্য চলতি বছরের শুরুতে গ্রেটাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্যও মনোনীত করা হয়েছিল।
বিভিন্ন সম্মাননা এবং পরিবেশ বিষয়ক স্কলারশিপ পেয়েছেন গ্রেটা থুনবার্গ। তবে একাধিক পুরস্কার তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন, কারণ সেগুলো পেতে হলে তার আকাশপথে সফর করা বাধ্যতামূলক ছিল। এ ছাড়া টাইম ম্যাগাজিন তাকে ২০১৮ সালের সবচেয়ে প্রভাবশালী ২৫ কিশোর-কিশোরীর তালিকায় স্থান দিয়েছে।
এত ছোট বয়সে জলবায়ু আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখার কারণে এবারের জাতিসংঘ জলবায়ু বিষয়ক ‘ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিট, ২০১৯’-এ বক্তব্য রাখতে আমন্ত্রণ জানানো হয় গ্রেটাকে। কিশোরী গ্রেটা সম্মেলনে অংশ নিতে রাজিও হন। কিন্তু তার শর্ত ছিল, উড়োজাহাজে আসবেন না তিনি। আসবেন এমন কোনো যানে, যেখানে কার্বন নিঃসরণ হবে শূন্যের কাছাকাছি।
অবশেষে গত আগস্টে যুক্তরাজ্য থেকে একটি বিশেষ ইয়ট জাতীয় জাহাজে নিউইয়র্কের উদ্দেশে রওনা দেন গ্রেটা। ‘মালিজিয়া টু’ নামক দ্রুতগতির জাহাজটি পানির নিচে টার্বাইন ঘোরানোর মাধ্যমে চলে।
ইয়টটি থেকে কোনো ধরনের কার্বন নিঃসরণ হয় না। এমনকি এতে ছিল না কোনো গোসলখানা বা টয়লেট। যাত্রীরা পুরোটা সময় শুকনো এবং বরফে জমানো খাবার খেয়ে দিন কাটিয়েছেন, গ্রেটাও। যাত্রাপথের নানা খুঁটিনাটি তিনি তার টুইটার অ্যাকাউন্টে শেয়ার করেছেন।
১৫ দিন ধরে আটলান্টিক মহাসাগরে প্রায় ৩ হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছান গ্রেটা।