ইচ্ছে করেই পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে আমাজন নদীর পারের হাজার হাজার এলাকায়। সেই আগুনে মাইলের পর মাইল বিশাল অঞ্চলজুড়ে পুড়ে চলেছে সুবজ গাছগাছালি। কয়লা হয়ে যাচ্ছে ব্রাজিলের আমাজন চিরহরিৎ অরণ্য।
সাম্প্রতিক কয়েক মাস ধরে চলা অগ্নিকাণ্ডে ধোঁয়ায় ভরে গেছে দক্ষিণ দেশটির আকাশ-বাতাস। ঘন কুয়াশায় পূর্ণ জনপদ থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট ও বিমানবন্দরগুলো। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, জরুরি অবস্থা ঘোষণা করছে স্থানীয় সরকার প্রশাসনগুলো। জনগণকে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে ঘরে অবস্থানের।
কিন্তু ঘরের মধ্যেও মুক্তি মিলছে না। কাশতে কাশতে বমি করে ফেলছে অনেকেই। ফুসফুসে ছাই ও ধূলিকণা ঢুকে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কথায় আছে, ‘কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ’- পরিবেশ, প্রকৃতি ও মানুষের এমন ভয়াবহ বিপদ সত্ত্বেও একদল লোভী মানুষ আগুনের এই ধোঁয়ায় টাকার গন্ধ খুঁজে বেড়াচ্ছে।
ধোঁয়া যত বাড়বে, বন তত পুড়বে। অর্থাৎ ধোঁয়া বাড়লেই জমি বাড়বে। পোড়া জমিতে উঠবে নতুন নতুন খামার। আমাজনে রয়েছে হাজার হাজার র্যাঞ্চ তথা গবাদি পশুর খামার। এখানকার আগুনের বেশিরভাগই লাগায় এসব খামারের মালিকরা। বেশিরভাগ খামারিই শত শত একর জমির মালিক।
নিউইয়র্ক টাইমসের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
আমাজনে যারা বাস করেন বা কাজ করেন তাদের মতে, অগ্নিকাণ্ড বড় ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় ডেকে আনছে। বিশ্বজুড়ে পরিবেশ আন্দোলন কর্মীদেরও একই মত। এটা একদিকে গণস্বাস্থ্যের জন্য প্রচণ্ড হুমকি তৈরি করছে, অন্যদিকে পরিবেশ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধ্বংস করে ফেলছে। আর এতে গবাদি পশুপালকরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
বিশাল আয়তনের সব খামার আর গো-চারণভূমি তৈরির জন্য জঙ্গল সাফ করে ফেলছে তারা। গরু ও শূকরের মাংস রফতানিতে ব্রাজিল এক নম্বর দেশ। উন্নত দেশগুলোর জনগণ এগুলোর আসল ভোক্তা। ‘ফাস্ট ফুড’র মূল উপাদান গো-মাংস।
অর্থনীতিতে গো-মাংসের প্রভাব এতই বেশি যে ‘বার্গার-নেশার অর্থনীতি’ বা ‘বার্গার-অর্থনীতি’ প্রত্যয় দুটিও প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। পশ্চিমের বার্গার-নেশা মেটাতে ২০১৮ সালেও ১৭ লাখ টন গো-মাংস রফতানি করেছে ব্রাজিল। এই রফতানির আকার ২০১৭ সালের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি।
বাণিজ্যিকভাবে গরু পালনের ক্ষতিকর দিকগুলো মারাত্মক ও বিধ্বংসী। বর্তমানে প্রায় ২০ কোটি গরু পালন করা হচ্ছে আমাজন ও এর চারপাশে।
আমাজনের ৪ লাখ ৫০ হাজার বর্গকিলোমিটার ইতিমধ্যেই গোচারণভূমিতে পরিণত হয়েছে। বিজ্ঞানী ও বিশ্লেষকরা এটাকে ইন্ডাস্ট্রি বা কারখানা বলছেন, কৃষি বা পশু পালন নয়।
যে পদ্ধতিতে বাজারের চাহিদা মেটানোর জন্য দ্রুততম সময়ে গবাদি থেকে গো-মাংস রফতানি করা হয়, তার সঙ্গে কারখানার উৎপাদনের মিল দেখা যায়। চলতি বছর এ পর্যন্ত যতটুকু বন উজাড় হয়েছে তার ৮০ ভাগই খামার মালিকদের হাতে ঘটেছে।
গরমের সময় আমাজনে প্রতি বছরই আগুন লাগে। কিন্তু এই বছর মাত্র আট মাসেই ৭৩ হাজারের মতো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
ব্রাজিলের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্পেস রিসার্চ স্যাটেলাইটে পাওয়া ছবি ও তথ্য পর্যালোচনা করে জানায়, এই বছরে বনে আগুন লাগার সংখ্যা এবং ব্যাপ্তি গত বছরের তুলনায় ৮৮ শতাংশ বেশি। সারা পৃথিবীর জন্যই এই তথ্য অত্যন্ত আশঙ্কাজনক।
আর তাই এর বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে ফুঁসে উঠেছে পরিবেশবাদীরা। শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে পরিবেশ বাঁচানোর প্রচারণা। ব্রাজিল থেকে গো-মাংস কিনতে পশ্চিমা দেশগুলোতে চাপে রাখতে কাজ করছে তারা।
অবৈধ হলেও পশু পালকদের জন্য আগুন লাগানোই হচ্ছে ঘন জঙ্গলকে চারণভূমিতে পরিণত করার সবচেয়ে সহজ, দ্রুত ও কার্যকর উপায়। কিন্তু ব্রাজিলে এই মুহূর্তে এদের বিচার কিংবা কোনো জেল-জরিমানা নেই।