অবৈধ পাথর ভাঙার মেশিনের প্রভাবে প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষতি
সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় অনুমোদন ছাড়াই অবৈধভাবে চলছে প্রায় ৪০০ পাথর ভাঙার মেশিন (স্টোন ক্রাশার)। নদীর তীর, মানুষের ঘরবাড়ি, ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে এগুলো স্থাপন করা হয়েছে। যত্রতত্র এগুলো স্থাপন করায় মারাত্মক শব্দদূষণের পাশাপাশি ক্ষতি হচ্ছে প্রকৃতি, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের।
বুধবার দুপুরে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলনকক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় এই তথ্য তুলে ধরা হয়। ‘স্টোন ক্রাশার মেশিনের অবৈধ ব্যবহার: জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিপর্যয় রোধে করণীয়’ শীর্ষক এই সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)।
সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন জেলা পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান।
‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন’ সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ানের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন বেলার সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক শাহ সাহেদা আখতার।
মূল বক্তব্যে বলা হয়, সুনামগঞ্জে অবকাঠামো নির্মাণের জন্য সংগৃহীত পাথর বিভিন্ন আকারে ভাঙানোর জন্য এই ক্রাশার মেশিন ব্যবহার করা হয়।
জেলার সদর, ছাতক, তাহিরপুর ও জামালগঞ্জ উপজেলায় সুরমা নদী, চলতি নদী, যাদুকাটা নদী, বৌলাই নদ, রক্তি নদীর তীরে, তাহিরপুরের লাউড়েরগড় ও আনোয়ারপুর এলাকায় মানুষের ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাজারের পাশে এসব মেশিন স্থাপন করা হয়েছে।
বেলার হিসাব অনুযায়ী জেলার সদর উপজেলায় ২৬টি, ছাতক উপজেলায় ১০০টি, তাহিরপুরে ৮৮টি এবং জামালগঞ্জ উপজেলায় ২৪টি স্টোন ক্রাশার মেশিন রয়েছে।
২০১৬ সালে ১২০টি ছিল। ২০১৯ সালে ১৮১টি এবং বর্তমানে আছে ২৩৮টি। তবে সভায় অংশ নেওয়া লোকজনের দাবি, জেলায় অবৈধভাবে ৪০০ পাথর ভাঙার মেশিন চলছে। এসবের কোনো অনুমোদন বা অনুমতি নেই।
বেলার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, এসব মেশিনের কারণে এলাকায় বায়ু, মাটি, পানি ও শব্দদূষণ হচ্ছে। এ কারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিক্ষা কার্যক্রম, আর্থসামাজিক, কৃষির ওপর।
স্টোন ক্রাশার মেশিন স্থাপনে নীতিমালা থাকলেও সুনামগঞ্জে এসব মানা হচ্ছে না। এসব মেশিন স্থাপনের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন বা লাইসেন্স, পরিবেশের ছাড়পত্র নেওয়ার কথা থাকলেও এসব নেওয়া হয়নি।
স্থান নির্ধারণে একটি কমিটি থাকলেও এসব কমিটির কোনো কার্যক্রম নেই। স্থানীয়ভাবে এসব মেশিন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা নানাভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় সাধারণ মানুষ এ নিয়ে কোনো প্রতিবাদ করতে পারেন না।
বেলার সমন্বয়ক শাহ সাহেদা আখতার বলেন, সিলেটের পাঁচটি উপজেলায় নীতিমালা অমান্য করে স্থাপিত ও পরিচালিত স্টোন ক্রাশার মেশিনের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে বেলা একটি রিট আবেদন করে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ২৪ জানুয়ারি উচ্চ আদালতের রায়ে অবৈধ স্টোন ক্রাশার মেশিন উচ্ছেদ, একটি জোন করে সব বৈধ স্টোন ক্রাশার মেশিন স্থানান্তর এবং স্টোন ক্রাশার মেশিন স্থাপন নীতিমালা ২০০৬ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।
সভায় জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, এ–সংক্রান্ত নীতিমালা বাস্তবায়নে প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে। জেলায় অন্তত চার’শ পাথর ভাঙার মেশিন আছে।
এগুলোকে একটা শৃঙ্খলায় আনা হবে। তবে রাতারাতি এসব বন্ধ করা যাবে না। এর সঙ্গে মানুষের জীবিকা জড়িয়ে আছে। তবে পরিবেশ ও মানুষের যাতে ক্ষতি না হয়, এ জন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে।
সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন সুনামগঞ্জ পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের সভাপতি এ কে এম আবু নাছার, সুনামগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি পঙ্কজ কান্তি দে, জেলা পরিষদের সদস্য সেলিনা আবেদীন, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এন্ড্রু সলমার, ‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সালেহীন চৌধুরী, জামালগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা সংবাদকর্মী অঞ্জন পুরকায়স্থ, ছাতক উপজেলার বাসিন্দা রতন দেবনাথ প্রমুখ।