করোনাভাইরাস রোগ (কোভিড-১৯) লকডাউন: ৬০ দিনের মধ্যে ভারতের যমুনা নদী পরিচ্ছন্ন রূপ নিল
-দীপক কুন্ডু
করোনাভাইরাস রোগ (কোভিড-১৯) লকডাউনের সময়ে প্রকৃতিতে অযাচিত পদক্ষেপ নেই, নেই যান্ত্রিক দূষণ। তাইতো দু’মাসের মধ্যে ভারতের যমুনা নদী প্রাকৃতিক ভাবেই পরিচ্ছন্ন হয়ে গেল। বিগত ২৫ বছরে পাঁচ হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয় করে বিভিন্ন মেয়াদের সরকার এমনটি করে দেখাতে পারেনি।

ভারতের যমুনা (Yamuna) নদী, গঙ্গা নদীর ২য় সর্ব বৃহৎ শাখা নদী এবং ভারতের সবচেয়ে লম্বা শাখা নদী। নদীটি ভারতের ঊত্তরাখন্ড রাজ্যের নিন্মতর হিমালয়ের বেন্ডারপোচ চূড়ায় ৬,৩২৭ মিটার (২০,৯৫৫ ফুট) উঁচুতে অবস্থিত ইয়ামুনট্রি হিমবাহ হতে উৎপন্ন হয়ে ১,৩৭৬ কিমি অতিক্রম করে এলাহাবাদের ত্রিবেনীসঙ্গম এ গঙ্গা নদীতে পতিত হয়েছে।
যমুনা নদীটি ভারতের উত্তরাখন্ড, হিমাচল প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা ও দিল্লীর উপর দিয়ে প্রবাহিত এবং এর তীরে যুমনা বা ইয়ামুনা নগর, দিল্লী, ফরিদাবাদ, মথুরা, আগ্রা, ইটাওয়া এবং পায়াগরাজ বা এলাহাবাদ শহর অবস্থিত।
মুঘলরা এই নদীকে কেন্দ্র করে তৎকালীন মুঘল সাম্রাজ্য গড়ে তোলে এবং প্রশাসনিক ও বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপন করে। এই নদীর তীরে মোগলরা প্রশাসনিক ও বসবাসের জন্য দূর্গ হিসাবে দিল্লী পোর্ট, আগ্রাপোর্ট নির্মাণ করে। সম্রাট শাহজাহান তার অমরকৃতি তাজমহল এই নদীর তীরেই নির্মাণ করেন।
এ ছাড়া হিন্দু পৌরাণিক অবতার শ্রীকৃষ্ণের জন্মস্থান মথুরা এই নদীর তীরে অবস্থিত এবং এই নদীর তীরেই শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী মথুরা মন্দির অবস্থিত। ১,৩৭৬ কিমি দীর্ঘ যুমনা নদীতে অনেকগুলো শাখা নদী পতিত হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য টনস নদী, হিন্দন নদী, কেন নদী, ক্যামবেল, ইটাওয়া, সিন্দ, শাসুর কাদারী, বেতুয়া নদী উল্লেখযোগ্য।


করোনাভাইরাস রোগ (কোভিড-১৯) লকডাউন চলাকালীন শিল্প কারখানার কার্যকলাপ বন্ধ ছিল এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক কার্যক্রম হ্রাস পাওয়ায়, যমুনা নদী আপনাতেই পরিষ্কার হয়ে গেছে।
ফলে অসংখ্য স্থানীয় ও পরিযায়ী পাখি পানিতে খেলা করার, ঝাঁপানোর সুযোগ পাচ্ছে। এখন যে কেউই নদীতে দেখতে পাবেন ধূসর বক, বড় বড় সারস ও হারগিলেসহ স্থানীয় ও পরিযায়ী পাখির ঝাঁক এবং এদের মৎস-উৎসব । নদীর স্বচ্ছ পানিতে এদেরকে সাঁতার কাটতেও দেখা যাচ্ছে।
বিগত ৩০ বছর ধরে যমুনা নদী নিয়ে গবেষণা করে আসা ওয়াইল্ড লাইফ ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া-দেরাদুনের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কর্মকর্তা ড. রাজীব চৌহান বলেন,”আমি ২০০০ সাল থেকে যমুনা অ্যাকশন প্ল্যানের সঙ্গে যুক্ত, কিন্তু নদীটিকে আমি কখনই এত পরিষ্কার দেখিনি।
বর্তমানে দূষণের মাত্রা অনেক কমে গিয়েছে এবং ইটাওয়া (ভারতের পশ্চিম উত্তর প্রদেশ রাজ্যের যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত একটি শহর; এটি ইটাওয়া জেলার প্রশাসনিক সদর দফতর)-এর কাছে পানি আরও পরিষ্কার হচ্ছে। এখানে চম্বল নদী থেকে স্বচ্ছ পানি এসে যমুনা নদীর পানির দূষণকে আরও কমিয়ে দিচ্ছে। লকডাউন সমস্ত নদীর উপর যে প্রভাব ফেলেছে তা দেখে আমি অবাক হয়েছি”।
প্রায় ১,৪০০ কিলোমিটার দীর্ঘ যমুনা নদী ভারতের সাতটি রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। পাশর্^বর্তী শিল্প-কল-কারখানা থেকে নির্গত দূষিত তরল বর্জ্যরে বেশিরভাগই অপরিশোধিত ভাবে এই নদীতেই পতিত হয়।
শুধুমাত্র হরিয়ানার পানিপথ ও দিল্লির মধ্যে ৩০০টিরও বেশি শিল্প-কারখানার নির্গত বর্জ্য যমুনা নদীটিকে দেশের সর্বাধিক দূষিত নদী হিসাবে পরিণত করেছে। যমুনা নদীর ৮০ শতাংশ দূষণকারী পদার্থ দিল্লি, আগ্রা এবং মথুরা থেকে নর্গিত হয়।
দিল্লির দূষণ নিয়ন্ত্রণ কমিটি-র এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে করোনাভাইরাস রোগ (কোভিড-১৯) প্রাক-লকডাউন দিনের তুলনায় এখন প্রায় ৩৩% পর্যন্ত যমুনা নদী পরিষ্কার হয়ে গেছে। উপরন্তু, কমিটি সূত্রে জানা গিয়েছে, মথুরা মোড়ের পরে পানি অনেক স্বচ্ছরূপে প্রবাহিত হচ্ছে।
দিল্লির জলাশয় পুনর্জীবনের, বিশেষত যমুনা নদীর জন্য কাজ করা পরিবেশ সংরক্ষণবিদ দিওয়ান সিং বলেন, “এই নদীটি তার নিজস্ব জীবতত্তি¡ক ক্ষমতা ব্যবহার করে নিজেকে পরিষ্কার করেছে। এখন রাজ্য সরকারগুলিকে নিশ্চিত করতে হবে, শিল্প-বর্জ্য যেন আবার তাতে না ফেলা হয়”।
ভারত করোনাভাইরাস রোগ (কোভিড-১৯) লকডাউনে যাওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই- স্বচ্ছ নদীর অপ্রত্যাশিত রূপকল্প, নীল আকাশ এবং হিমালয়ের বিভিন্ন দিক থেকে গৃহীত তুষার-ঢাকা শৃঙ্গগুলির দৃশ্যপট ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়ে উঠেছে।
পূর্বের তুলনায় এখন যেন ভিন্ন জগৎ। প্রতিবন্ধকতাহীন প্রকৃতির এসব অপূর্ব চিত্রের মাধ্য দিয়ে পরিবেশের উপর মানুষের কার্যকলাপের কু-প্রভাব এখন আর অস্পষ্ট থাকছে না ।